BDC CRIME NEWS24
মামলা চালাতে খরচ হয় ৩৫ লাখ টাকা:
প্রকাশ : ১৪ জানুয়ারি ২০২৫, ০৯: ১৩
ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক অঙ্গনের পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সোচ্চার ছিলেন মাওলানা নুরুল আমিন। লেখালেখি ও বক্তব্য-বিবৃতির মাধ্যমে ওই সরকারের ইসলাম ও দেশবিরোধী কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করতেন তিনি।
পাশাপাশি নিজের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানেও সময় দিতেন। একদিন ব্যবসায়িক কাজ শেষে মোটরসাইকেলে ঢাকা থেকে ফরিদপুর ফেরার পথে নবীনগর থেকে বিনা অপরাধে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। তিন দিন গুম করে রাখার পর আইসিটি আইনে মামলা দিয়ে রিমান্ডে নির্যাতনের পাশাপাশি জেলে পাঠানো হয় তাকে।
আওয়ামী লীগের বিরোধিতার অভিযোগে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার এই সন্তানকে জামিনে বিলম্ব করেন বিচারক। দীর্ঘ আট মাস কারাভোগের পর জামিন পান ইসলামী ঐক্যজোটের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির এই সদস্য। তবে কারামুক্তির পরও নানা হুমকির কারণে এলাকা ছেড়ে দুই বছর ঢাকায় আত্মগোপনে ছিলেন তিনি। আওয়ামী সরকার পতনের আগ পর্যন্ত দিন কাটিয়েছেন আতঙ্ক নিয়ে। শেখ হাসিনার শাসনের সেই কালো দিনগুলোর কথা তুলে ধরেছেন আমার দেশ পাঠকদের জন্য।
২০১৬ সালের ২৭ জুলাই নবীনগর ব্রিজ এলাকা থেকে মোটরবাইকসহ মাওলানা নুরুল আমিনকে আটক করে পুলিশ। ধরেই চোখ বেঁধে একটি গাড়িতে নিয়ে যায়। সারা রাত গাড়িতে নিয়ে বেড়ায়। এ সময় কেউ কেউ বলেন, সে জঙ্গি, তাকে ক্রসফায়ার দিয়ে দাও।
গুলি লোড দিতে বলে একজনকে। এভাবে তিন দিন তাকে গুম করে রাখে। তবে প্রথম দিন রাতে আশুলিয়ার দিকে নিয়ে যায় বলে অনুমান তার। এ সময় কোনো নির্যাতন তারা করেনি। তবে তিন দিন পর ধামরাই থানায় নিয়ে বিভিন্নভাবে তাকে মানসিক নিপীড়ন করা হয়।
তিনি জানান, এ সময় জিজ্ঞাসা করা হয়, আমি আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে সভা-সমাবেশে কথা বলি কেন? তাদের বিপক্ষে লেখালেখি কেন করি? শাপলা চত্বরে আমি কোরআন পুড়িয়েছি, শাপলা চত্বরের ঘটনায় আমার ভূমিকা ছিল। পরে আমার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ না পেয়ে আইসিটি আইনে মামলা দেওয়া হয়।
কাপড়ের দোকানের মালপত্র কিনতে মোটরবাইক নিয়ে ঢাকায় এসেছিলেন মাওলানা নুরুল আমিন। জিনিসপত্র কুরিয়ারে পাঠিয়ে রাতে তেজগাঁও এলাকায় পরিচিত এক মাদরাসায় রাত কাটান।
পরের দিন ফরিদপুরের উদ্দেশে রওনা হয়ে পথিমধ্যে নবীনগরের পলাশবাড়ীতে যান এক ইমাম বন্ধুর কাছে। সেখান থেকে ফেরার পথেই রাত ৮টার দিকে তাকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। এ সময় তার সঙ্গে থাকা ১ লাখ ২৫ হাজারের বেশি টাকাও নিয়ে যায় তারা।
নবীনগর সেতুর কাছ থেকে ধরলেও গ্রেপ্তার দেখানো হয় তিন দিন পর ধামরাইয়ের ইসলামপুর থেকে। গুমের তিন দিন তাকে ধামরাই থানাতেই রাখা হয় বলে তার ধারণা। এ সময় বাইরের কোনো কিছুই তিনি দেখতে পারেননি। পশ্চিম মনে করে উত্তরদিকে নামাজ পড়েছেন। তাকে সুরা ইয়াসিন পড়তে বলার মধ্য দিয়ে অঘোষিত রিমান্ড শুরু হয়। এরপর পুলিশ জিজ্ঞাসা করে, শেখ হাসিনা ভালো নাকি খালেদা জিয়া ভালো।
তিনি বলেন, আমার গাড়ি চালানো দেখে তারা নাকি সন্দেহ করে। এরপর আইসিটি আইনে মামলা দিয়ে সাইবার ট্রাইব্যুনাল আদালতের মাধ্যমে তিন দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়। ১০ দিনের রিমান্ড চেয়েছিল ধামরাই থানা-পুলিশ। আদালত তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে।
রিমান্ডে নিয়েই আমাকে হাত-পা বেঁধে পায়ের তলায় লাঠি দিয়ে পেটানো হয়। অকথ্য ভাষায় গালাগাল, আলেম-ওলামাদের গালাগালসহ নানাভাবে নির্যাতন করা হয় রিমান্ডে। ওই থানার ওসি তদন্ত দীপঙ্কর সাহা তাকে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ ও নির্যাতন চালান। মামলার বাদী ছিলেন মাহমুদ।
গত ৮-১০ বছর আদালতে হাজিরার সময় তাদের চেহারা আর দেখেননি তিনি। আদালতে কোনো সাক্ষীও হাজির করতে পারেননি তারা। রিমান্ডে নিয়ে পরিবারকে ফোন দিয়ে ২ লক্ষাধিক টাকাও নেয় পুলিশ। এখনো পর্যন্ত তার কাছ থেকে নেওয়া তিনটি মোবাইল ফেরত দেওয়া হয়নি।
আটকের তিন দিন পর তার পরিবারকে ফোন দেয় পুলিশ। সে সময় তাদের টাকা নিয়ে ধামরাই থানায় আসতে বলে। আদালতে ওঠাতে ও কাপড়চোপড়ের জন্য খরচ লাগার কথা বলে তারা। তাদের ফোন পেয়ে তার ভাই, শ্যালক ও স্থানীয় কিছু লোকজন আসে।
মাওলানা নুরুল আমিন জানান, তাদের যখন আদালতে ওঠানো হতো, তখন ম্যাজিস্ট্রেট তাদের ফাইল ধরতে চাইতেন না, ফেলে দিতেন। প্রায় সাড়ে ৪ মাস পর তার আইনজীবী আদালতে বলেন, তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, তিনি নিরপরাধ। তাকে জামিন দেওয়া হোক।
এ সময় জজ বলেন, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হলে তিনি আওয়ামী লীগবিরোধী কেন? এ জন্য তাকে আরও কিছুদিন থাকতে হবে, জামিন হবে না। দীর্ঘ আট মাস দুদিন কারাভোগের পর জামিন পান তিনি। কারাগার থেকে বের হওয়ার পর পুলিশের সেই কর্মকর্তা দীপঙ্কর সাহা তাকে ফোন দিয়ে হুঁশিয়ারি দেন, আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে কোনো তৎপরতা চালালে আবার ধরে নিয়ে আসা হবে।
দলীয় কর্মসূচিতে বক্তব্যের পাশাপাশি আগে থেকেই ফেসবুক পেজে লেখালেখি করতেন মাওলানা নুরুল আমিন। সেগুলো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকরা ফলো করেই তাকে টার্গেট করতে পারেন বলে ধারণা তার।
তিনি বলেন, মুক্তির পরও তার ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নানা হুমকি-ধমকি আসে। একপর্যায়ে ব্যবসা ছেড়ে দেন তিনি। নিজ এলাকা নগরকান্দা ছেড়ে অনেকটা আত্মগোপনের জন্য ঢাকার একটি মাদরাসায় চাকরি নেন তিনি। দুই বছর সেখানে চাকরি করেন। তবে সরকারের বিরুদ্ধে বক্তব্য ও লেখালেখি অব্যাহত ছিল।
পরিস্থিতি কিছুটা শিথিল হলে ২০১৯ সালে নগরকান্দায় গিয়ে নিজে ‘মারকাজুল আশরাফ আল ইসলামী মাদরাসা ও কওমি একাডেমি’ নামে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। বর্তমানে সেখানেই পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। পাশাপাশি চলছে ব্যবসা-বাণিজ্যও।
তবে দীর্ঘদিন কারাবাসে থাকায় আয় বন্ধ আর ব্যাপক খরচের কারণে অনেকটা জীর্ণশীর্ণভাবেই দিন কাটাচ্ছেন তিনি। কারণ মামলা চালাতে গিয়ে প্রায় ৩৫ লাখ টাকা খরচ হয়েছে তার। কারাগারে থাকার সময় খাওয়া-দাওয়া করতে মাসে ৩০-৩৫ হাজার টাকা করে খরচ হয়েছে। আদালতেও ব্যাপক খরচ। শেষদিকে আইনজীবীর সঙ্গে মোটা অঙ্কের টাকা চুক্তিতে তার জামিন হয়।
কারাগারের নানা স্মৃতিচারণ করে এই তরুণ আলেম বলেন, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জীর্ণশীর্ণ একটি কক্ষে থাকতে দেওয়া হয় তাকে। সেখানে কারও সঙ্গে কথাবলা ও চলাফেরা নিষেধ ছিল। কারাগারেও নজরদারিতে ছিলেন তিনি। সেখানে তিনি তাফসির করতেন, একপর্যায়ে সেটাও বন্ধ করে দেওয়া হয়।
১৫-২০ দিন পরপর কোর্টে ওঠানো হতো তাকে।
মাওলানা নুরুল আমিন বলেন, আমি জীবনে কোনো ক্রাইমের সঙ্গে জড়িত হইনি। অথচ একটা মিথ্যা মামলা দিয়েই আমার লাইফ শেষ করে দিয়েছে পুলিশ। ফরিদপুরে স্থানীয় কওমি মাদরাসা থেকে সর্বোচ্চ লেখাপড়ার পাশাপাশি পবিত্র কোরআনের হাফেজ তিনি। নগরকান্দার বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী আশরাফ আলীর সন্তান তিনি।
রিমান্ডের সময় হাত-পা বেঁধে মেঝেতে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। অনেক সময় দুই হাতে হ্যান্ডকাফ লাগিয়ে পায়ের বুড়ো আঙুলের ওপর ভর দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গ্রিলের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখত।
তিনি বলেন, কারাগারে অসংখ্য আলেমকে দেখেছেন তিনি। তাদের দীর্ঘদিন কোর্টে ওঠাত না, জামিন দিত না। সেখানে আলেম-ওলামা নির্যাতনের ভিন্ন অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন তিনি। গ্রেপ্তারের আগেও সোশ্যাল মিডিয়ায় সরকারবিরোধী সমালোচনামূলক লেখালেখির জন্য আওয়ামী লীগের লোকরা হুমকি দিত তাকে। গ্রেপ্তারের পর সেই ফেসবুক আইডি অকার্যকর করে দিয়েছে। সেটা আর উদ্ধার করতে পারেননি তিনি।
৫ আগস্টের আগের পরিস্থিতি সম্পর্কে মাওলানা নুরুল আমিন বলেন, সে সময় আমরা হুমকির মধ্যে থাকতাম। ঠিকমতো সভা-সমাবেশ করতে পারিনি। ঠিকমতো ধর্মীয় বক্তব্য দিতে পারতাম না, কথা বলতে পারতাম না। আমরা আমাদের ধর্মীয় অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিলাম।
জুলাই-আগস্টে ফরিদপুরের আন্দোলনে ছিলাম। ৫ আগস্টের দিনও বাজার করতে ঢুকলে নগরকান্দা থানার ওসি (তদন্ত), একজন হিন্দু অফিসার আমাকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা করেন। অবশ্য বিকালেই পরিস্থিতির পরিবর্তন হওয়ায় তিনি আমার কাছে ক্ষমা চেয়ে নেন। আজও দেখা হলে তিনি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখার কথা বলেন। আজও তিনি একই থানায় কর্মরত আছেন। তবে আল্লাহর রহমতে আমি মুক্ত অবস্থায় আছি।
সূত্র: আমার দেশ
No comments:
Post a Comment