BDC CRIME NEWS24
ব্যাংক খাতে নিয়েছেন সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা-
শেখ হাসিনার প্রশ্রয়ে নাসার নজরুলের লুটপাট:
প্রকাশ : ১৪ জানুয়ারি ২০২৫, ০৮: ৪৩
দেশের ব্যাংকিং খাতে নিজেকে প্রধান ব্যক্তি হিসেবে দাঁড় করানো নজরুল ইসলাম মজুমদার ঋণের নামে দেশের সাতাশটি ব্যাংক থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা। এছাড়াও তিনি বেনামি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে কয়েক হাজার কোটি টাকা লুটেছেন।
দেশের ব্যাংকগুলোর এই বিপুল পরিমাণ অর্থের সিংহভাগই পাচার করেছেন বিদেশে। ব্যাংকিং খাতে বেপরোয়া চাঁদাবাজির ‘মাধ্যম’ ছিলেন মজুমদার। টানা সতেরো বছর বেসরকারি এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদ দখলে রাখেন তিনি। সেই সঙ্গে ব্যাংক মালিকদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) সভাপতির পদটি তার দখলে ছিল দেড় দশক।
নজরুল ইসলাম মজুমদার ব্যাংকগুলো থেকে বিপুল অঙ্কের চাঁদাবাজি করেছেন হাসিনার পক্ষে। কখনো মুজিববর্ষ, কখনো হাসিনার জন্মদিন, আবার কখনো শেখ রাসেল বা শেখ কামালের জন্মদিনের অনুষ্ঠানের নামে চাঁদা তুলতেন ব্যাংক মালিকদের কাছ থেকে। শীত-বন্যা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ এলে কপাল খুলত নাসা নজরুলের। প্রাকৃতিক দুর্যোগকে উপলক্ষ্ বানিয়ে বিভিন্ন ব্যাংকে চাঁদাবাজি হতো তার ইচ্ছেমতো।
ব্যাংকের ঋণ আর চাঁদাবাজির টাকায় দেশে যেমন তিনি সম্পদের পাহাড় গড়েছেন, তেমনি বিদেশে নিজের ও স্ত্রী-কন্যার নামে কোম্পানি খুলে ব্যবসার আড়ালে বৈদেশিক মুদ্রা পাচার করেছেন।
সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে মজুমদারের সম্পদ রয়েছে। বিদেশে অর্থ পাচারে তার নিয়ন্ত্রণাধীন এক্সিম ব্যাংককে ব্যবহার করেছেন মজুমদার, এমন তথ্য পেয়েছে গোয়েন্দা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ফিনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট- বিএফআইইউ। এর জেরে নজরুল ইসলাম ও তার পরিবারের সদস্যদের ব্যাংক হিসাব তলব করা হয়েছে। এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যানের পদ থেকেও তাকে সরিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
পুনর্গঠন করা হয়েছে এক্সিম ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। একই সঙ্গে নজরুল ইসলাম মজুমদার ও তার সব প্রতিষ্ঠানের অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং কর ফাঁকি নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেল (সিআইসি)। বিএফআইইউ’র সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা গেছে; পুলিশ, এনবিআর এবং সিআইডি মিলে একটি সমন্বিত তদন্ত টিম গঠন করা হয়েছে নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যানের দুর্নীতি, অনিয়ম ও অর্থ পাচার বিষয়ে তদন্ত করার জন্য। ইতিমধ্যে এই টিম কাজ শুরু করেছে।
নজরুল ইসলাম মজুমদারের দুর্নীতি-অনিয়ম বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র হুসনে আরা শিখা আমার দেশকে বলেন, নাসা গ্রুপের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করা হয়েছে। শিগগিরই সব তদন্ত শেষে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে তার বিরুদ্ধে। তবে নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদারের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। তিনি বর্তমানে জেল হাজতে রয়েছেন।
নজরুল ইসলাম মজুমদার নাসা গ্রুপ ও তার সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে ২৭টি ব্যাংক থেকে সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকার ঋণ নিয়েছেন। এসব অর্থ ফেরত না দেওয়ার কারণে তার ঋণের স্থিতি দিন দিন বেড়েছে। এতদিন আওয়ামী সরকারের ক্ষমতার দাপটে মজুমদার ব্যাংকের টাকা ফেরত না দিলেও খেলাপি হননি। যদিও এসব ঋণ খেলাপি যোগ্য।
ইসলামী ব্যাংক থেকে ২ হাজার ১৭৪ কোটি টাকা
নাসা গ্রুপের আটটি কনসার্ন প্রতিষ্ঠান ইসলামী ব্যাংক থেকে ২ হাজার ১৭৪ কোটি টাকার ঋণ নেন। পুরো ঋণ দেওয়া হয় ব্যাংকের মতিঝিল শাখা থেকে। নিয়ম অনুযায়ী একটি শাখা থেকে এত পরিমাণ ঋণ নেওয়ার সুযোগ নেই। সর্বোচ্চ ১ হাজার কোটি টাকার ঋণ নিতে পারে। তবে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে আরও এক হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ নেন মজুমদার।
তথ্য অনুযায়ী, নাসা স্পিনিং লিমিটেডের নামে ২৬৩ কোটি ১১ লাখ টাকার ঋণ নিয়েছেন, এর মধ্যে ৬৪.১ কোটি টাকা ওভারডিউ হয়ে গেছে। মূলত কিস্তি পরিশোধ না করার কারণেই ওভারডিউ হয়েছে। এছাড়া নাসা তাইপেই নামে ২৭৯.১০ কোটি টাকা নিয়েছে, যার ২১ কোটি ৪৩ লাখ টাকা ওভারডিউ। নাসা টেক্সটাইল ইউনিটের নামে ৪৩৬ কোটি টাকা ঋণ রয়েছে।
নাসা সুপার গার্মেন্টসের নামে ২২৭ কোটি ৪২ লাখ, যার মধ্যে ২১ কোটি ওভারডিউ। নাসা সুপার ওয়াশের নামে ২১৬ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে, এর মধ্যে ২০ কোটি ৮৭ লাখ টাকা ওভারডিউ। তাছাড়া গার্মেন্টস ইউনিটির নামে ঋণ নিয়েছে এক হাজার ১৮৯ কোটি টাকা।
ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে দুই হাজার কোটি টাকার ঋণ
নজরুল ইসলাম মুজমদারের নাসা গ্রুপ ও তার সংশ্লিষ্ট ছয়টি প্রতিষ্ঠানে ন্যাশনাল ব্যাংকের গুলশান শাখা থেকে এক হাজার ৯৬১ কোটি টাকার ঋণ নিয়েছেন। এসব ঋণ পরিশোধ না করার কারণে খেলাপি হয়ে যায়। ইতিমধ্যে চারবার পুনঃতফসিল সুবিধাও নেওয়া হয়েছে।
তথ্য অনুযায়ী, লিজা ওয়াশের নামে ৩৮২ কোটি টাকার ঋণ রয়েছে। নাসা তাইপেই স্পিনারস লিমিটেডের নামে ৬৫৬ কোটি টাকা, নেটিভ প্যাকেজের নামে ৩৩৭ কোটি, নাসা সুইং থ্রেড নামে ৭৫ কোটি এবং ফিরোজ গার্মেন্টসের নামে ২১০ কোটি টাকার ঋণ নিয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শেখ আক্তার উদ্দিন আহমেদ আমার দেশকে বলেন, নাসা গ্রুপের ঋণ গত ডিসেম্বরে পুনঃতফসিল সুবিধা নিয়েছিল। এখনও ঋণটি নিয়মিত রয়েছে। আগামী মার্চের মধ্যে টাকা পরিশোধ না করলে খেলাপি হয়ে যাবে।
আইএফআইসি থেকে ১২০০ কোটি টাকার ঋণ
আইএফইসি ব্যাংকের গুলশান শাখা থেকে নাসা ও তার সংশ্লিষ্ট ৪ প্রতিষ্ঠানের ঋণ এক হাজার ১৫২ কোটি টাকা। এসব ঋণ পায় সালমান এফ রহমানের সঙ্গে সখ্যতার কারণে।
তথ্য অনুযায়ী, নাসা প্রপার্টিজ লিমিটেডের নামে ৪০৪ কোটি টাকার ঋণ নিয়েছে। ব্রিকস অ্যান্ড মোটরসের নামে ৫০৯ কোটি, নাসা স্পিনারস অ্যান্ড গার্মেন্টসের নামে ১৬০ কোটি এবং নাসা সুপ্রিম ওয়াশের নামে ৭৯ কোটি টাকার ঋণ নিয়েছে।
এসআইবিএলের দুই শাখা থেকে সাড়ে ৬০০ কোটি ঋণ
তারল্য সংকটে ধুঁকতে থাকা এসআইবিএল থেকে ঋণ বের করেন নজরুল ইসলাম মজুমদার। ব্যাংকের দুটো শাখা থেকে ৬০০.৪২ কোটি টাকার ঋণ নিয়েছেন। বনানী শাখা থেকে ৪৩৭ কোটি এবং মহাখালী থেকে ২০৫ কোটি টাকা। ৬টি প্রতিষ্ঠানের নামে এসব ঋণ বের করেন।
তথ্য অনুযায়ী, ওয়েস্টার্ন ড্রেসের নামে ২৩৫ কোটি, এমএনসি অ্যাপারেল্স লিমিটেডের নামে ১৬৩ কোটি, নাসা বেসিক ওয়াশের নামে ২৯ কোটি, এনআই মজুমদার নামে ১০.২০ কোটি এবং ব্রিকস অ্যান্ড মটরসের নামে ২০৫ কোটি টাকার ঋণ নিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে দেখা যায় কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানকে লিমিটের বেশি ঋণ দেওয়া হয়েছে।
আল আরাফাহ ইসলামী থেকে ৬০০ কোটি
গ্রুপের ৫টি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক থেকে ৫৯০ কোটি টাকার ঋণ নিয়েছেন, পুরো ঋণ দিয়েছে ব্যাংকের মতিঝিল শাখা।
তথ্য অনুযায়ী, এসব ঋণের মধ্যে নাসা তাইপেই ডেনিমের নামেই ২২৬ কোটি টাকার ঋণ। এছাড়া নাসা তাইপেই টেক্সটাইল মিলসের নামে ১৫৮ কোটি, এএনডব্লিউ হোমসে ২০৪ কোটি এবং নাসা তাইপেই স্পিনারসের নামে প্রায় ২ কোটি টাকার ঋণ রয়েছে। যদিও ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে ফান্ডেড ঋণের যে লিমিট ছিল তা অতিক্রম করে দিয়েছে।
শাহজালাল ইসলামী থেকে ৪৫৮ কোটি টাকার ঋণ
নাসা গ্রুপের ৫টি প্রতিষ্ঠান শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক থেকে ৪৫৭ কোটি ৬৩ লাখ টাকার ঋণ নিয়েছেন। পুরো ঋণটি দেওয়া হয় ব্যাংকের মতিঝিলের প্রধান শাখা থেকে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, নাসা তাইপেই টেক্সটাইল মিলসের নামে ৯০ কোটি, নাসা বেসিসের নামে ২৭২ কোটি, নাসা বেসিস হাই-টিচ ওয়াশের নামে ৪৫.৩৬ কোটি এবং নাসা স্পিনারসের ৫১ কোটি টাকা।
এছাড়া ডাচ্-বাংলা থেকে ঋণ নিয়েছে ২৪৫ কোটি, উত্তরা ব্যাংক থেকে ১২০ কোটি, প্রিমিয়ার ব্যাংকের ইসলামী ব্র্যাঞ্চ থেকে ২৪ কোটি, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের গুলশান শাখা থেকে ১৪ কোটি, যমুনা ব্যাংকের মহাখালী ব্র্যাঞ্চ থেকে ৫৭ কোটি, পূবালী ব্যাংকের মহাখালী করপোরেট শাখা থেকে ২২ কোটি, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের মতিঝিল শাখা থেকে ২১ কোটি, সাউথইস্ট ব্যাংকের গুলশান শাখা থেকে ৩৪ ও কারওয়ান বাজার শাখা থেকে ২৭৩ কোটি, এনআরবিসি ব্যাংকের গুলশান শাখা থেকে ২১ কোটি, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের গুলশান শাখা থেকে ১২০ কোটি, ইউনিয়ন ব্যাংকের গুলশান শাখা থেকে ২৬৮ কোটি টাকা, ফার্স্ট সিকিউরিটির মহাখালী শাখা থেকে ৫৩১ কোটি ও গুলশান শাখা থেকে ২৩৫ কোটি, ব্যাংক এশিয়ার গুলশান লিংক রোড শাখা থেকে ৬৯ কোটি, সিটি ব্যাংক থেকে ২৫৪ কোটি এবং ইউসিবি ব্যাংক থেকে ৯০ কোটি টাকার ঋণ রয়েছে। এছাড়া ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড (ইডকল) থেকে ৬২ কোটি টাকার ঋণ নেন তিনি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, নজরুল ইসলাম মজুমদার ক্ষমতার দাপটে এসব ব্যাংক থেকে সীমার অতিরিক্ত ঋণ নিয়েছেন। প্রায় সাড়ে ৩০০ কোটি টাকার বেশি সীমা অতিরিক্ত ঋণ রয়েছে।
অর্থ পাচার
আমার দেশের অনুসন্ধানে যুক্তরাজ্যে ‘নাসা প্রোপার্টিজ লিমিটেড’ নামে একটি আবাসন কোম্পানির সন্ধান পাওয়া গেছে। সেখানে নজরুল ইসলাম মজুমদার পরিচালক হিসেবে ২০১৯ সালের ২২ জুলাই বিনিয়োগ করেন। এর বাইরে লন্ডনে অন্তত চার কোম্পানিতে নাসা নজরুলের মেয়ে আনিকার বিনিয়োগ রয়েছে। এগুলো হলো- নাসা প্রপারটিস লিমিটেড, এএনডব্লিউ প্রপারটিস লন্ডন লিমিটেড, এএনডব্লিউ অ্যাসোসিয়েটিস লন্ডন লিমিটেড এবং এক্সিম এক্সচেঞ্জ কোম্পানি লিমিটেড।
কর ফাঁকি দিয়েছেন মজুমদার
অবৈধ সম্পদ গোপন ও কর ফাঁকি দিতে পদে পদে জালিয়াতি করেছেন নজরুল ইসলাম মজুমদার। ভুয়া দলিল তৈরি করে মাছের খামার থেকে ২১৫ কোটি টাকা আয় দেখিয়েছেন এক্সিম ব্যাংকের সাবেক এই চেয়ারম্যান। অভিযোগ মিলেছে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আয়কর কর্মকর্তাদের যোগসাজশে অনিয়ম করেন তিনি। ২০১৯-২০ অর্থবছরের আয়কর রিটার্নে নিজেকে মাছের খামারি দাবি করেন নজরুল ইসলাম মজুমদার। কোম্পানির নাম মজুমদার ফিশারিজ। খুলনার দাকোপ ও সাতক্ষীরায় সাড়ে ১১শ’ হেক্টর জমিতে চিংড়ি ও কার্প জাতীয় মাছ ছাষ করার তথ্য দেন রিটার্নে। মাছ বিক্রি করে এক বছরেই আয় দেখান দুইশ দুই কোটি টাকা।
২০২০-২০২১ অর্থবছরেও মৎস্য খামার থেকে ১৩ কোটি টাকা আয় দেখান মজুমদার। এনবিআর কর্মকর্তারা জানান, মৎস্য চাষের মাধ্যমে বিশাল অঙ্কের অর্থ বৈধ করার বিষয়ে আপত্তি তোলেন অনেকেই। বিষয়টি গড়ায় আয়কর আপিল ট্রাইব্যুনালে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ছাড় পান নজরুল ইসলাম মজুমদার। নজরুল ইসলাম মজুমদার জেলহাজতে থাকায় এসব অভিযোগের বিষয়ে তার বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
সূত্র: আমার দেশ
No comments:
Post a Comment