BDC CRIME NEWS24
মাওলানা রফিকুল ইসলাম মাদানীর চরিত্র হননের জন্য নারীর সঙ্গে ‘শুটিং’ করায় পুলিশ:
প্রকাশ : ২৭ জানুয়ারি ২০২৫, ০৯: ২১
দেশের আলোচিত ইসলামি প্রচারক মাওলানা রফিকুল ইসলাম মাদানী ‘শিশু বক্তা’ হিসেবেই বেশি পরিচিত। ওয়াজ মাহফিল ছাড়াও দেশ ও ইসলামবিরোধী বিভিন্ন প্রতিবাদ কর্মসূচিতেও দেখা যেত তাকে। তার এই তৎপরতা থামাতে জঘন্য নির্যাতনের পথ বেছে নেয় পতিত আওয়ামী সরকার।
বিনা অপরাধে আটকের পর একের পর এক বানোয়াট মামলা দিয়ে ৩২ মাস কারাবন্দি ও ২৬ দিন রিমান্ডে নির্যাতন করে ফ্যাসিবাদী সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
দেশের জনপ্রিয় একজন তরুণ আলেমের চরিত্রহননে পর্নোগ্রাফির অভিযোগ ছাড়াও শার্ট-প্যান্ট পরিয়ে, সিগারেট ধরিয়ে অচেনা নারীর সঙ্গে ‘ফটোশুটিং’ করে পুলিশ। রিমান্ডে চড়-ধাপ্পড় আর গালাগাল ছিল স্বাভাবিক বিষয়। গ্রেপ্তারের আগে এবং সাত মামলায় জামিনের পরও তাকে গোয়েন্দা নজরদারিতে রাখা হতো। বাধা দেওয়া হতো ওয়াজ মাহফিলেও।
আওয়ামী শাসনামলে আলেম-ওলামাদের ওপর নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরে মাওলানা রফিকুল ইসলাম মাদানী আমার দেশকে বলেন, এ দেশের আলেম-ওলামা ও ইসলামপন্থিদের একেবারে বিলীন করে দেওয়ার বড় একটি পরিকল্পনা ছিল শেখ হাসিনা সরকারের।
ভারতের ইন্ধনে, সরাসরি তাদের দিকনির্দেশনায় এবং ‘র’-এর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদতে বাংলাদেশের আলেম-ওলামা ও ইসলামপন্থিদের কোণঠাসা করে দেওয়ার মাস্টারপ্ল্যান ছিল তাদের। সেই প্ল্যানের অংশ হিসেবেই ২০২১ সালে শত শত আলেম-ওলামাকে বন্দি করা হয়। আর সে সময় সর্বপ্রথম গ্রেপ্তার হন তিনি।
একের পর এক আলেম-ওলামা গ্রেপ্তারের খবরে এমনতিতেই শঙ্কায় ছিলেন মাওলানা রফিকুল ইসলাম মাদানী। কারণ ২০২১ সালের ২৫ মার্চ মতিঝিল শাপলা চত্বরে মোদির আগমনবিরোধী ছাত্রদের একটি বিক্ষোভে অংশ নিয়ে একবার আটক হন তিনি। পল্টন থানায় চার ঘণ্টা আটকে রাখার পর বিভিন্ন গালাগাল ও হুমকি-ধমকি দিয়ে তাকে ছেড়ে দেয় পুলিশ। এরপর ২০২১ সালের ৬ এপ্রিল গভীর রাতে র্যাব পরিবারের সদস্যদের ওপর হামলা চালিয়ে তাকে আটক করে। এরপর ৩২ মাস ধরে তার ওপর চলে অত্যাচারের স্টিমরোলার।
রফিকুল ইসলাম মাদানীকে গাড়িতে তুলেই র্যাবের একজন ওয়্যারলেসে কাকে যেন বলেন, স্যার মিশন সাকসেস, নিয়ে আসছি। গাড়িতে চোখ খুলে দেওয়া হয়। একই বাড়ি থেকে তার এক ভাই ও ভাগনেকে ধরে নিয়ে আসে। পথে ভাইকে ছেড়ে দিলেও ভাগনেকে তার সঙ্গেই নেওয়া হয়। গাজীপুরের কাছাকাছি পৌঁছালে আবার তার মুখে কালো কাপড় লাগিয়ে দেয়। তাকে উত্তরার র্যাব-১-এর কার্যালয়ে আনা হয়। পথে ফজরের ওয়াক্ত চলে গেলেও তাকে নামাজ পড়তে দেওয়া হয়নি।
সকাল ৭টার দিকে সেখানে পৌঁছালে বাথরুম সেরে একটি রুমে ফজরের নামাজ পড়েন তিনি। পরে একজন প্রবেশ করেন সেই রুমে। তার আচরণ ছিল চরম মাস্তানিসুলভ। চেয়ারে বসা ব্যক্তি রফিকুল ইসলাম মাদানীর সামনে রাখা টেবিলে দুই পা উঠিয়ে মুখে সিগারেট ফুঁকে হাস্যরস করেন। হুট করে ভয়ংকর হয়ে মা-বাবা তুলে গালি দেওয়া শুরু করেন তিনি।
এভাবে একের পর একজন এসে নানা বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন তাকে। হঠাৎ একজন তাকে জোরে ধাপ্পড় মারেন। বীভৎস চেহারায় গালাগালও চলে সমানে। প্রচণ্ড আঘাতে কানে অনেকক্ষণ আওয়াজ শোনা বন্ধ ছিল, চোখ দিয়ে পড়ছিল পানি। পরে দুজন তাকে ধরে ছোট একটা রুমে নিয়ে যায়। সেখানে বিদ্যুতের চেয়ার, ঝোলানোর যন্ত্র এবং ওয়ালে ছিল বীভৎস চিত্র। বিশেষ ধরনের লাঠি, চাকুসহ অন্যান্য যন্ত্রপাতি দেখে আতঙ্কিত হওয়ার মতো একটি রুম। সেখান থেকে চিৎকার করলেও বাইরে কোনো আওয়াজ যাবে না। রুমের সামনে উচ্চ শব্দের দুটি ফ্যান চালিয়ে রাখা হয়।
সেখানে তাকে কোনো আঘাত না করলেও কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করে আরেকটি রুমে নেওয়া হয়। এ সময় সেখানে হিন্দি ভাষায় কথা বলতে শোনেন তিনি। দিনভর এসব নির্যাতনের পর রাতে নেওয়া হয় থানায়। র্যাবের পক্ষ থেকে করা হয় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলা। সেখানে অবস্থানকালে তাকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেন নন্দলাল নামের একজন কর্মকর্তা। পর্যায়ক্রমে সপ্তাহখানেকের মধ্যে গাজীপুরের বাসন, ময়মনসিংহ, রাজধানীর মতিঝিল, পল্টন, মতিঝিল ও তেজগাঁও থানায় সন্ত্রাসবিরোধীসহ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তার বিরুদ্ধে সাতটি মামলা করা হয়। এসব মিথ্যা মামলায় ২৬ দিন রিমান্ডে ছিলেন তিনি।
পরদিন ৮ এপ্রিল গাজীপুর আদালতের মাধ্যমে কাশিমপুর কারাগারে পাঠানো হয় রফিকুল ইসলাম মাদানীকে। সেখানে ‘৬০ সেল পূর্ব’ নামে ভবনের নিচতলায় এমন জায়গায় রাখা হয়, যেখানে সব ফাঁসির আসামি বা কুখ্যাত অপরাধীদের রাখা হয়। টয়লেটের পাশের ওই রুমটি ছিল খুব দুর্গন্ধময়। লকআপে বন্দি অবস্থায় প্রায় আট মাস খুবই কষ্টে কাটে তার।
মাঝে কয়েক দিন কেরানীগঞ্জেও নেওয়া হয় তাকে। এ সময় স্বাভাবিক কোনো সুবিধা পাননি, পরিবারের কেউ দেখা করতে এলে হয়রানি করা হতো। এক/দেড় মাসের মাথায় শুধু তার মা সাক্ষাতের সুযোগ পান। অন্য রুমে যেতে আট মাসের মাথায় অনশন করলে বেহুঁশ হয়ে পড়েন তিনি। তখন তাকে নেওয়া হয় হাসপাতালে। পরে তাকে ওপরতলায় রাখা হয়।
কারাগারে অবস্থানের দেড় মাসের মাথায় দুদিনের রিমান্ডে নেওয়া হয় মাদানীকে। স্বাভাবিক কিছু জিজ্ঞাসাবাদ শেষে পাঠানো হয় কেরানীগঞ্জ কারাগারে। সেখানে মামুনুল হকসহ অনেক আলেমের সঙ্গে দেখা হয় তার। ওই কারাগারে ঢোকার সময় গেটে চেক করার নামে লুঙ্গির ভেতরে মাথা ঢুকিয়ে নির্লজ্জ আচরণ করা হয়।
রফিকুল ইসলাম মাদানী বলেন, আমরা আসরের নামাজের পর আলেমরা মিলে কষ্ট থেকে মুক্তি পেতে জালেমের বিরুদ্ধে কান্নার সঙ্গে দোয়া করতাম। কিন্তু কেরানীগঞ্জ জেলের হিন্দু সুপার সেটা বন্ধ করে দেন।
তরুণ এই আলেম সবচেয়ে জঘন্য ও নাটকীয় অত্যাচারের শিকার হন তেজগাঁও থানার পাঁচ দিনের রিমান্ডে। আর এই নির্যাতনের মূল পরিচালক ছিলেন তেজগাঁও জোনের তৎকালীন ডিসি হারুন (ডিবির হারুন অর রশীদ)। এক দিন তার শরীরের মাপ নেওয়া হয় (পরে বুঝতে পারেন, সেই মাপ অনুযায়ী শার্ট-প্যান্ট বানানো হয়)।
রমজান মাসে মধ্যরাতে হঠাৎ তাকে নিয়ে যাওয়া হয় হাতিরঝিলে। গামছা দিয়ে তার মুখ-চোখ ঢেকে দেওয়া হয়। ওসি শাহ আলম ও এসআই শোয়েব একটি গাড়িতে করে তাকে নিয়ে যান। একটি লেকের কাছে নিয়ে তার চোখ খুলে দিতেই সেখানে ২৫/৩০ বছর বয়সি বোরকাধারী এক নারীকে দেখতে পান।
সেখানে তাকে শার্ট-প্যান্ট পরাতে তার লুঙ্গি-ফতোয়া টেনে খোলার চেষ্টা করা হয়। অবস্থা বেগতিক দেখে নিজেই সেগুলো পরে নেন। হালকা আলোয় কারও চেহারা ভালো বোঝা যাচ্ছিল না। দূরে আশপাশে অনেক লোক থাকলেও নারীটি কাছে এসে জড়িয়ে ধরে তাকে। এ সময় আল্লাহর সাহায্য চেয়ে চিৎকার করে কান্না করেন তিনি।
মেয়েটি তাকে থামিয়ে বলেন, আমি আপনার বোনের মতো। মেয়েটির কাঁদের ওপর তার হাত দিয়ে দেয়, সেটি সরিয়ে নিলে আবার দিয়ে দেয় এক পুলিশ। এ সময় ‘ফটোশুটিংয়ের’ জন্য চারদিক থেকে অনেকগুলো ক্যামেরার লাইট জ্বলছিল। সব যানচলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়।
মাদানী বলেন, মূলত তাকে প্যান্ট-শার্ট পরিয়ে সিগারেট টানা অবস্থায় মেয়ের পাশে ছবি তুলে খুব খারাপ-জঘন্য মানুষ হিসেবে প্রচারের উদ্যোগ নেয়। শুটিংয়ের মতো তাকে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানার স্টাইল তারাই বারবার শিখিয়ে দেয়। আলেমদের হেয় করার প্ল্যান ছিল এটা। প্রকাশ্যে উলঙ্গ করে নির্যাতনের সময় লজ্জা বাঁচাতে তিনি সরকারবিরোধী কিছু না বলার স্বীকারোক্তি দিয়েছিলেন। সেই বক্তব্য পরে সরকার প্রচার করে। দুই ঘণ্টাব্যাপী ওই ‘শুটিংয়ে’ পুলিশের সঙ্গে মিডিয়া ও ‘র’-এর লোকও ছিল বলে তার ধারণা।
হাতিরঝিল থেকে ফেরার পথে গাড়িতে ওসি শাহআলম তাকে বলেন, হুজুর আমাদের কিছুই করার নেই। ডিসি হারুন এটা জানেন কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, হারুন সাহেবই তো এটার মাস্টারমাইন্ড। এই গ্রেপ্তারের সপ্তাহখানেক আগেই ডিসি হারুন রফিকুল ইসলাম মাদানীকে হেলিকপ্টারে করে তার এলাকায় কিশোরগঞ্জের মাহফিলে নিয়ে যান। ফেরার সময় পকেটে হাদিয়াও দেন তিনি। মাদানী বলেন, এসব নির্যাতনের ভয়ংকর পরিণতি হয়েছে। আল্লাহ তাদের লাঞ্ছিত করেছেন। হারুন এখন পলাতক।
তেজগাঁও থেকে আবার তাকে ডিবিতে রিমান্ডে নেওয়া হয়। সেখানে তৎকালীন ডিবিপ্রধান হাফিজ আখতার তাদের অনেক গালাগাল করেন। এক দিন জিজ্ঞাসাবাদ টিমের বাইরের একজন হঠাৎ তাকে থাপ্পড় দিয়ে চেয়ার থেকে ফেলে দেয়। সেখানে ১২ দিন রিমান্ড থেকে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। একপর্যায়ে হাসপাতালে নিয়ে তাকে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
চরিত্রহননের জন্য তার বিরুদ্ধে পর্নোগ্রাফির অভিযোগও করেছিল পুলিশ। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সে সময়টা ভাবতেও লজ্জা লাগে। চরিত্রহননের জন্য তারা অনেক কিছু করেছে।
১৯৯৪ সালের ২ এপ্রিল জন্মগ্রহণকারী রফিকুল ইসলাম মাদানী পাঁচ ভাই ও তিন বোনের মধ্যে সবার ছোট। মাত্র আট বছর বয়সে দরিদ্র বাবাকে হারান তিনি। ২০১২ সাল থেকে ‘শিশু বক্তা হিসেবে’ বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিলে বক্তব্য দেওয়া শুরু করেন। বর্তমানে সারাদেশে মাহফিলে ব্যস্ত সময় কাটান এই আলেম।
সূত্র: আমার দেশ
No comments:
Post a Comment