BDC CRIME NEWS24
ড্রাইভিং লাইসেন্সের জট খুলছে না:
প্রকাশ: ০২ জানুয়ারি, ২০২৫ ০০:০০
সারা দেশে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) কাছে আবেদন করা প্রায় পাঁচ লাখ ড্রাইভিং লাইসেন্স আটকা পড়ে আছে। বিআরটিএ সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। এতে লাইসেন্সপ্রত্যাশীদের ভোগান্তি বাড়ছে।
সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, চাহিদার তুলনায় লাইসেন্সের ছাপা কার্ড সরবরাহ করতে পারছে না ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
আবার দিনে যেখানে ১০ হাজার কার্ড ছাপানোর সক্ষমতা রয়েছে, সেখানে কার্ড ছাপা যাচ্ছে মাত্র চার হাজার।
আবার লাইসেন্সের কার্ড হাতে দেওয়ার আগে বিআরটিএ গ্রাহকদের ই-ড্রাইভিং লাইসেন্স দিলেও সেটি গ্রহণযোগ্য বলে মানছে না পুলিশ। এতে কার্ড হাতে পাওয়ার আগে ই-লাইসেন্স দিয়ে কাজ চালিয়ে নিতে পারছেন না গ্রাহক। এই ই-লাইসেন্স পাসপোর্ট অফিসও গ্রহণ করছে না।
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের ট্রাফিক উত্তরা বিভাগের বিমানবন্দর জোনের সহকারী কমিশনার সাখাওয়াত হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, লাইসেন্সের আবেদনের সময়সীমা উত্তীর্ণ না হলে সেটি আমলে নেওয়া হয়। তা ছাড়া বিশেষ পরিস্থিতিতে অন্য সব কিছু ঠিক থাকলে কাগজের সময়সীমা পেরিয়ে গেলেও সেটি গ্রহণ করা হয়। তবে নিয়মমাফিক নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ড্রাইভিং লাইসেন্স নেওয়া উচিত।
নতুন করে গ্রাহকের ভোগান্তির আরেক কারণ হয়েছে ডাক বিভাগ।
সরকারি এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বিআরটিএর চুক্তি অনুযায়ী, গ্রাহকের হাতে ড্রাইভিং লাইসেন্সের কার্ড পৌঁছে দেওয়ার কথা ডাক বিভাগের। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি তৃতীয় পক্ষকে আবার এই কাজের দায়িত্ব দিয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী, ঢাকার ভেতর তিন দিন এবং ঢাকার বাইরে সর্বোচ্চ সাত দিনের মধ্যে কার্ড পৌঁছে দেওয়ার কথা ডাক বিভাগের। কিন্তু সেটি হচ্ছে না। বিআরটিএ বলছে, পোস্ট অফিসেই ৫৪ হাজার ড্রাইভিং লাইসেন্স ডেলিভারির অপক্ষায় পড়ে আছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাপার দায়িত্বে রয়েছে ভারতীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্স। প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ রয়েছে আর ছয় মাস। মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্সের সঙ্গে নতুন করে চুক্তির সম্ভাবনা নেই। ফলে শেষ মুহূর্তে এসে কার্ড ছাপানো নিয়ে প্রতিষ্ঠানটিরও গড়িমসি রয়েছে। বিআরটিএর পক্ষ থেকে মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্সকে দায়ী করা হচ্ছে। পলিকার্বনেট কার্ডের সংকটের কারণে পর্যাপ্ত লাইসেন্স ছাপানো যাচ্ছে না বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন।
জানতে চাইলে বিআরটিএর চেয়ারম্যান মো. ইয়াসীন কালের কণ্ঠকে বলেন, “আমি দায়িত্বে এসে পুরনো জট ‘লিগ্যাসি’ হিসেবে পেয়েছি। তবু দায় এড়িয়ে যাচ্ছি না। ড্রাইভিং লাইসেন্সের সংকট দূর করার চেষ্টা করা হচ্ছে। ডাক বিভাগের সঙ্গে কয়েকবার আলোচনা করেছি, সচিব বরাবর চিঠিও দেব। পুলিশকে জানিয়েছি ই-লাইসেন্স গ্রহণ করতে।”
ঠিকাদারের দুর্বলতা
২০১১ সালের নভেম্বর থেকে স্মার্ট লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে। প্রথম পাঁচ বছর সরবরাহে সমস্যা হয়নি। এর পর থেকে সংকট শুরু হয়। শুরু থেকে স্মার্ট কার্ড সরবরাহ করে আসছিল বিআরটিএর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান টাইগার আইটি বাংলাদেশ লিমিটেড। বিআরটিএর সঙ্গে কয়েক দফা চুক্তি হয়েছিল প্রতিষ্ঠানটির।
বিআরটিএ সূত্রে জানা গেছে, টাইগার আইটি বাংলাদেশ লিমিটেডের সঙ্গে বিআরটিএর চুক্তি শেষ হয় ২০২১ সালের ২২ জুন। তারপর নতুন ড্রাইভিং লাইসেন্স দিতে নতুন ঠিকাদার নিয়োগ করতে বেশ সময় চলে যায়।
ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়া পুরনো প্রতিষ্ঠান টাইগার আইটি বাংলাদেশ লিমিটেড নতুন প্রতিষ্ঠান মাদ্রাজ সিকিউরিটিজ প্রিন্টার্সের কাছে গ্রাহকদের তথ্য হস্তান্তর করেনি। ফলে আগে থেকে আটকে পড়া প্রায় সাড়ে ১২ লাখ লাইসেন্স দিতে পারেনি বিআরটিএ। পরে ধাপে ধাপে বিআরটিএ প্রায় ছয় লাখ ড্রাইভিং লাইসেন্স বিতরণ করেছে। আরো চার লাখ ঝুলে ছিল। সেই সংখ্যাই কমে আবার বাড়ে।
২০২০ সালের জুলাইয়ে বিআরটিএ ২০২৫ সালের জুনের মধ্যে ৪০ লাখ কার্ড সরবরাহের জন্য মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্সের সঙ্গে ১২০ কোটি টাকার চুক্তি করে। কিন্তু এ পর্যন্ত মাত্র ২০ লাখ কার্ড সরবরাহ করা হয়েছে। বাকি কার্ড সরবরাহের জন্য সময় আছে মাত্র ছয় মাস। যদিও দিনে দু-তিন হাজার নতুন আবেদন জমা পড়ছে। ফলে পুরনো জট কমানো কঠিন হয়ে পড়ছে।
বিআরটিএর পরিচালক (প্রকৌশল) শীতাংশু শেখর বিশ্বাস কালের কণ্ঠকে বলেন, এখন সাড়ে চার লাখের বেশি লাইসেন্সের আবেদন জমা রয়েছে। আগের আবেদনগুলো আগে ছাপা হচ্ছে। এতে নতুন করে যাঁরা আবেদন করছেন, তাঁদের কার্ড আটকে যাচ্ছে। এর মধ্যে একটি মেশিন নষ্ট হয়ে গেছে। তাই সক্ষমতা অনুযায়ী কার্ড ছাপানো যাচ্ছে না। স্মার্ট কার্ড বিতরণে বিলম্বের কারণে বিকল্প হিসেবে ই-ড্রাইভিং লাইসেন্সকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
ডাক বিভাগের বিড়ম্বনা
বিআরটিএ বর্তমানে আবেদনকারীর ড্রাইভিং লাইসেন্স ডাক বিভাগের মাধ্যমে হোম ডেলিভারি দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে। ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রিন্ট হয়ে যাওয়ার পরও মাসের পর মাস ঘুরে পোস্ট অফিস থেকে কোনো তথ্য পান না গ্রাহকরা। এতে পোস্ট অফিস থেকে লাইসেন্স হাতে পেতে ঘুরতে হয় আরো কয়েক মাস।
বিআরটিএতে ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য আবেদন করার সময় গ্রাহককে দুটি বিকল্প দেওয়া হয়—বিআরটিএ থেকে সরাসরি সংগ্রহ অথবা পোস্ট অফিসের মাধ্যমে হোম ডেলিভারি নেওয়ার। যেসব গ্রাহক পোস্ট অফিসের হোম ডেলিভারি নিয়েছেন, তাঁরাই ভোগান্তিতে পড়ছেন বলে অভিযোগ গ্রাহকদের।
ডাক অধিদপ্তর সূত্র বলছে, লাইসেন্স বিতরণে বিলম্বের পেছনে বেশ কিছু সমস্যা রয়েছে। অনেক সময় বিআরটিএ ডাক অধিদপ্তরে পুরনো তারিখের কার্ড পাঠায়। এতে গ্রাহক মনে করেন, ডেলিভারিতে বিলম্ব হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডাক অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘নিয়মিত দিনে তিন-চার হাজার কার্ড বিআরটিএ দেয়। ওই হিসাবেই আমাদের প্রস্তুতি রয়েছে। একদিন দেখি, তারা ৪০ হাজার কার্ড পাঠিয়েছে। এত কার্ড একসঙ্গে সামাল দেওয়ার সক্ষমতা আমাদের নেই। বুঝতেই পারছেন, কেন দেরি হচ্ছে।’
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বলছেন, পোস্ট অফিস সেবায় এখনো আধুনিকতার ছোঁয়া লাগেনি। তাই গ্রাহকদের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। এটা বেসরকারি কোনো কুরিয়ার সার্ভিসকে দিলে আরো দ্রুত ও সহজে গ্রাহকরা ড্রাইভিং লাইসেন্সটি পেতে পারেন। বর্তমান চুক্তি যাচাই করে দেখা যেতে পারে।
সূত্র: কালের কণ্ঠ
No comments:
Post a Comment