BDC CRIME NEWS24
দেড়শ কোটি টাকার জমির মালিক সাবেক প্রতিমন্ত্রী মহিববুর রহমান মুহিবের স্ত্রী ফাতেমা আক্তার রেখার:
(ত্রিশ দলিলে রয়েছে অন্তত ৩৭ একর জমি * একজন কলেজ শিক্ষক কীভাবে এত সম্পদের মালিক হলেন তা নিয়ে প্রশ্ন)
প্রকাশ: ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী মহিববুর রহমান মুহিবের স্ত্রী ফাতেমা আক্তার রেখার নামে ৩০টি দলিলে রয়েছে অন্তত ৩৭ একর জমি। সব জমিই পর্যটনকেন্দ্র কুয়াকাটা ও পায়রা বন্দরের আশপাশে। কম করে হলেও এসব জমির মূল্য দেড়শ কোটি টাকা হবে। রেখা একজন কলেজ শিক্ষক হয়ে কীভাবে এত জমির মালিক হলেন তা স্থানীয়দের কাছে এক রকম রহস্য।
তারা বলছেন, ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পান মুহিব। নির্বাচনে সহজেই তিনি এমপি নির্বাচিত হন। স্বামী এমপি নির্বাচিত হওয়ার পরই টাকা আর জমির নেশায় পেয়ে বসে মুহিবপত্নীকে। দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ উপায়েই এত সম্পদের মালিক হয়েছেন তিনি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৯ সালের ২১ নভেম্বর তাপস সাহা গং নামে এক হিন্দু পরিবারের কাছ থেকে কোটি টাকা দিয়ে ৮শ শতাংশ (৮ একর) জমি কেনেন রেখা। এই জমির অবস্থান ইটবাড়িয়া মৌজায়। দলিল নং-৪৫১২। ২০২৪ সালে ধুলাসার মৌজায় আলমগীর হোসেন হাওলাদারের কাছ থেকে নেন ৫ দশমিক ২৬ একর জমি। ২০২২ সালের ২৬ ডিসেম্বর ৬৬৭০নং দলিলে বৌলতলীতে রিয়াজুল ইসলাম মিলন তালুকদারের কাছ থেকে কেনেন ০.৬১ একর জমি। ২০১৭ সালের ৩১ আগস্ট কাউয়ারচর মৌজায় আব্দুস সত্তার গংয়ের কাছ থোকে নেন দেড় একর, দলিল নং ৪১২০। একই সালের ৩১ আগস্ট ১ দশমিক ৩৪ একর জমি কেনেন রেখা। যার দলিল নং ৪১১৯।
২০১৯ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর কাউয়ারচর মৌজায় ৩৯৬২নং দলিলে স্থানীয় দাদন মিয়ার ১ দশমিক ১২ একর জমি কেনেন মাত্র ২২ লাখ ৪৫ হাজার টাকায়। ২০১৮ সালের ১২ এপ্রিল ধুলাসার মৌজায় মোশারেফ হাওলাদার গংয়ের কাছ থেকে নেন ১ দশমিক ২১ একর জমি। একই এলাকায় পরের বছরের ১৯ জুন ২৫৪৬নং দলিলে দশমিক ৩৮ একর জমি কেনেন।
২০২৩ সালের ১১ অক্টোবর ৫২১২নং দলিলে বৌলতলী মৌজায় ১ দশমিক ৩৯ একর ধানী জমি নেন স্থানীয় আবুল কাশেম গংয়ের কাছ থেকে। ২০১৯ সালের ২ জানুয়ারি কাউয়ারচর মৌজায় আবদুল ছত্তার গংয়ের ০ দশমিক ৭৬ একর জমি লিখে নেন রেখা। যার দলিল নং -৪০১১। ২০২৩ সালের ২১ সেপ্টেম্বর ধুলাসার মৌজায় নাজিম সিকদার গংয়ের দেড় একর জমি দলিল করে নেন মহিবপত্নী ফাতেমা আক্তার। যার দলিল নং-৫০১৭। ২০১৯ সালের ২ অক্টোবর কাউয়ারচরে জলিল গংয়ের ৩৯ শতাংশ জমি বাগিয়ে নেন রেখা।
২০১৮ সালের ২৩ এপ্রিল ধুলাসার মৌজার সোনা মিয়া গং ও নুর সাঈদ গংয়ের কাছ থেকে ৪৮ লাখ টাকায় কেনেন একটি জমি। একই জায়গায় ৪০৮২নং দলিলে রয়েছে রেখার আরও ৩০ শতাংশ জমি। বৌলতলীতে ২০২২ সালের ২৬ ডিসেম্বর স্থানীয় আজিজুর রহমানের ১০২ শতাংশ জমি মাত্র ৬ লাখ টাকায় দলিল করেন রেখা। দলিল নং-৬৬৭২।
একই সালে তিনি ফিরোজা বেগমের কাছ থেকেও সমপরিমাণ জমি দলিল করেন একই স্থানে। যার দলিল নং-৬৬৭১। ধুলাসারের আব্দুল মালেক গংয়ের ১৯০ শতাংশ, গঙ্গামতিতে ৩০ শতাংশ, ২০২০ সালে রফিকুল ইসলাম গংয়ের কাছ থেকে কেনেন ১৫৪ শতাংশ জমি। এছাড়া ২০১৮ সালে ০.৪৫ একর, ২০১৯ সালে ০.২০ একর, ২০১৭ সালে দেড় একর ও ০.৪২ একর জমি কেনের রেখা।
ধুলাসার ইউনিয়নের সাবেক এক চেয়ারম্যান নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুগান্তরকে জানান, স্কুল-কলেজের চাকরি বাণিজ্য, টেন্ডার বাণিজ্য ও টিআর কাবিখার কাজ না করে পুরো টাকা লুটপাট করে নিয়েছেন তিনি। সেই অর্থেই কুয়াকাটা ও পায়রা বন্দরের মতো জায়গায় এত জমি কিনেছেন তিনি।
ফাতেমা আক্তার রেখা আলহাজ জালাল উদ্দিন কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ। কলেজের অফিস সহায়ক আলমগীর হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ফাতেমা আক্তার কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক ছিলেন। ২০১৮ সালে তিনি ভারপ্রাপ্ত প্রভাষক হয়েছেন। তার বেতন সর্বসাকুল্যে ৩৮ হাজার টাকার মতো।
এসব বিষয়ে জানতে ফাতেমা আক্তার রেখার মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। তার কলাপাড়ার বাড়িতে গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি। বাড়িতে তালা দেওয়া। স্থানীয়রা জানান, ৫ আগস্টের পর থেকে রেখাকে কোথাও দেখা যায়নি।
অবশেষে হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছ থেকে দলিল করা ৯৯ লাখ ৭৮ হাজার টাকা মূল্যের আট একর জমির মালিকানা অস্বীকার করলেন সাবেক প্রতিমন্ত্রী মো. মহিববুর রহমানের স্ত্রী ফাতেমা আক্তার। গত ১ অক্টোবর ঢাকার একটি নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে এক হলফনামায় এ জমির মালিকানা তিনি অস্বীকার করেন।
হলফনামায় দাবি করেছেন, রেজিস্ট্রিকৃত ওই সাফ-কবলা দলিল আমি ও আমার নিকটজনের অজান্তে কে বা কারা সম্পন্ন করেছে, যা আমি অবগত নই। আমি বিষয়টি অবগত হয়ে আমার প্রতিনিধির মাধ্যমে বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত জেনে দলিলের কপি সংগ্রহ করি।
তিনি হলফনামায় আরও উল্লেখ করেছেন, আমি বা আমরা অবগত না থাকায় অত্র দলিলে আমি বা আমার নিকটজনের কোনোরূপ স্বত্ব বা মালিকানা থাকবে না। ভবিষ্যতেও দাবি করব না। এ নিয়ে ভবিষ্যতে কোনো অসুবিধা বা বিতর্ক, বিবাদ দেখা দিলে আমি বা আমার নিকটজন দায়-দায়িত্ব বহন করব না। এমনকি দলিলটির মূল্য ও রেজিস্ট্রি খরচ তিনি পরিশোধ করেননি বলে উল্লেখ করেছেন।
এই হলফনামাটি সম্প্রতি কলাপাড়া সাবরেজিস্ট্রি অফিসে দাখিল করা হয়েছে। এ নিয়ে এখন মানুষের মাঝে চলছে বিভিন্ন ধরনের আলোচনা সমালোচনা।
জানা গেছে, ২০১৯ সালের ২১ নভেম্বর এ জমি ফাতেমা আক্তারের নামে খেপুপাড়া সাবরেজিস্ট্রি অফিসে ৪৫১২ নম্বর দলিলের মাধ্যমে ক্রয় দেখানো হয়েছে। তাপস সাহা গং এ জমির বিক্রেতা। কলাপাড়া উপজেলা সদরের পৌরসভা লাগোয়া ইটবাড়িয়া মৌজার জেএল নং-০৮, ১৭৩/১নং খতিয়ানে এই জমির অবস্থান দেখানো রয়েছে।
সাধারণ মানুষের প্রশ্ন ২০১৯ সালের সম্পাদিত দলিল নিয়ে এখন কেন অস্বীকার করলেন। আর কোটি টাকার সম্পত্তির দলিল সম্পাদনের জন্য রেজিস্ট্রি খরচ বাবদ স্ট্যাম্প ২ লাখ ৯৯ হাজার ২৪০ টাকা, ফি এক লাখ ৯৯ হাজার ৮২০ টাকা, ডিসি ও ইউপি কর বাবদ ২ লাখ ৯৯ হাজার ৩৪০ টাকা, উৎস কর বাবদ ৯৯ হাজার ৭৮০ টাকা, মোট ৮ লাখ ৯৮ হাজার ১৮০ টাকা কে খরচ করল।
পটুয়াখালী-৪ আসনের (কলাপাড়া-রাঙ্গাবালী) সাবেক সংসদ সদস্য ও প্রতিমন্ত্রী মহিববুর রহমান এবং তার স্ত্রী ফাতেমা আক্তার ২০১৭ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত অন্তত একক ও যৌথভাবে ২৭টি দলিলের মাধ্যমে বিভিন্ন মৌজায় ৩৫ একর জমি ক্রয় করেছেন। এর মধ্যে আবার ঘোষণাপত্র দলিলের মাধ্যমেও কুয়াকাটায় ৮০ শতক জমির গ্রহীতা হয়েছেন। একইভাবে আমমোক্তারনামার মাধ্যমেও কিছু জমির মালিক হয়েছেন।
এ ব্যাপারে ফাতেমা আক্তারকে একাধিকবার মোবাইল করা হলে তার মোবাইল বন্ধ পাওয়া গেছে।
কলাপাড়া উপজেলা সাবরেজিস্ট্রার কাজী নজরুল ইসলাম জানান, তিনি ফাতেমা আক্তারের হলফনামাটি পেয়েছেন।
সূত্র: যুগান্তর
No comments:
Post a Comment