BDC CRIME NEWS24
দীপু মনির ‘ছায়া মন্ত্রী’ ছিলেন ভিসি মশিউর
প্রকাশ: ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:৫১ এএম
আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা ও সাবেক মন্ত্রী আমির হোসেন আমুর তদবিরে প্রথমে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) ও পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সমাজবিজ্ঞান বিভাগে প্রভাষক পদে চাকরি। এরপর মৌলিক লেখালেখির যোগ্যতা না থাকলেও শুধু অন্যের লেখা কপি পেস্ট করে অধ্যাপক পদে পদোন্নতি। চাঁদপুর পুরান বাজার ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ রতন কুমার মজুমদারের মাধ্যমে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির সঙ্গে সখ্য হয়ে নতুন পরিচয়ে পরিচিত হন তিনি। প্রথমে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য এবং পরে সর্বোচ্চ উপাচার্য পদে আসীন হন। সেখানেই থেমে যাননি। সব প্রটোকল ভেঙে মন্ত্রীর সঙ্গী হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন দেশ-বিদেশ। শিক্ষা সম্পর্কিত কোনো অনুষ্ঠান না হলেও দীপু মনির পাশের আসনেই সব সময় আসন পাতা ছিল তার। ‘ছায়া মন্ত্রী’ হিসেবে সামলেছেন পুরো শিক্ষা খাত। তিনি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য সাবেক উপাচার্য ড. মশিউর রহমান।
আওয়ামী লীগ তৃতীয় মেয়াদে সরকার গঠনের পর ২০১৯ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান ডা. দীপু মনি। শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়ার পর ২০২১ সালে ঢাবির সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মশিউর রহমানকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগের বন্দোবস্ত করেন তিনি। অভিযোগ রয়েছে, তুলনামূলক জুনিয়র ও প্রশাসনিকভাবে অনভিজ্ঞ হলেও ব্যক্তিগত পছন্দের কারণেই অধ্যাপক মশিউরকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য থেকে সরাসরি উপাচার্য হিসেবে নিয়োগের ব্যবস্থা করেন ডা. দীপু মনি। এরপর মন্ত্রীর আরও কাছাকাছি চলে যাওয়ার চেষ্টা করেন ড. মশিউর। শিক্ষা নিয়ে ওই অর্থে গবেষণা না থাকলেও শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত প্রায় সব অনুষ্ঠানেই তিনি ছিলেন নিয়মিত অতিথি। শিক্ষামন্ত্রীর অধিকাংশ অনুষ্ঠানে মশিউরের অপ্রাসঙ্গিক উপস্থিতি বা অতিথি হওয়া ছিল অন্যদের জন্য বিব্রতকর। শিক্ষা, রাজনৈতিক, সামাজিক, প্রশাসনিক এমনকি সাংবাদিকদের অনুষ্ঠানেও দীপু মনির সঙ্গে মশিউরের অতিথি হওয়া যেন রীতি হয়ে উঠেছিল। তাদের গভীর সখ্যের বিষয়টি ছিল ‘ওপেন সিক্রেট।’ শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, এ সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে অনেকটাই ছায়া মন্ত্রীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন অধ্যাপক মশিউর। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ থেকে শুরু করে মন্ত্রণালয়ের নানা আর্থিক কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ হতো মশিউরের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ হস্তক্ষেপে। সে সময় এ নিয়ে তৎকালীন শিক্ষা উপমন্ত্রী, অধ্যাপক মশিউর ও ডা. দীপু মনির ত্রিমুখী স্নায়ুযুদ্ধের কথাও শোনা যায়। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর উপাচার্য অধ্যাপক মশিউর রহমান গত ১১ আগস্ট পদত্যাগ করেন।
জানা গেছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য মশিউর রহমানের সঙ্গে সাবেক মন্ত্রী দীপু মনির গভীর সখ্যের অন্তরালে ছিল তদবির বাণিজ্য। মশিউর ছিলেন দীপু মনির ঘুষ বাণিজ্যের মাধ্যম। তার সময়েই সবচেয়ে বেশি দুর্নীতির জাল ছড়িয়েছে উচ্চশিক্ষা খাতের প্রায় সর্বস্তরে। সিন্ডিকেট করে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তারা। তদবির-বাণিজ্যের জন্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মশিউর রহমান অন্তত অর্ধশতবার চাঁদপুরে দীপু মনির বাসায় আসা-যাওয়া করেছেন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকা খরচ করে স্পিডবোটে চাঁদপুরে গেছেন অনেকবার। দীপু মনি ও মশিউর দুজনের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন, একসঙ্গে অতিথি হওয়া, ঢাকা থেকে চাঁদপুরে নিয়মিত যাতায়াত ছিল সবার চোখে পড়ার মতো। তবে হয়রানি, মামলা-হামলার ভয়ে সবাই তা চেপে যেতেন।
সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, তদবির-বাণিজ্যের পাশাপাশি কমপ্লিট স্যুটের প্রতি বেশ দুর্বলতা ছিল উপাচার্য মশিউরের। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অতিথি হয়ে নামিদামি ব্লেজার স্যুট উপঢৌকন হিসেবে গ্রহণ করতেন তিনি। মিরপুর কলেজ, ধানমন্ডি কারিগরি ও ব্যবসায় ব্যবস্থাপনা কলেজ, উত্তরা ফ্যাশন টেকনোলজি কলেজ, কুড়িগ্রামের ফুলবাড়িয়া ডিগ্রি কলেজসহ বিভিন্ন কলেজ থেকে এসব এসব উপঢৌকন গ্রহণ করেন তিনি। পাশাপাশি নিজের স্ত্রী এবং মন্ত্রীর জন্য দামি জামদানি শাড়ি উপহার নিতেন উপাচার্য। এক্ষেত্রে তার পিএস ওয়াহিদুল বাশার মাধ্যম হিসেবে কাজ করতেন।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গ্রেপ্তার হয়েছেন সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। গত ১১ বছর ধরে পররাষ্ট্র, শিক্ষা ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব সামলেছেন সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ এ মন্ত্রী। যদিও সবচেয়ে বেশি আলোচিত-সমালোচিত হয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী থাকাকালে। অভিযোগ রয়েছে, তার সময়েই সবচেয়ে বেশি দুর্নীতির জাল ছড়িয়েছে উচ্চশিক্ষা খাতের প্রায় সর্বস্তরে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুধু দুর্নীতি নিয়ে নয়, সমালোচিত হয়েছেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মশিউর রহমানের সঙ্গে থাকা ‘গভীর সখ্য’ নিয়েও। শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, এ সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে অনেকটাই ছায়া মন্ত্রীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন অধ্যাপক মশিউর, যা নিয়ে তৎকালীন শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, অধ্যাপক মশিউর ও ডা. দীপু মনির ত্রিমুখী স্নায়ুযুদ্ধ ছিল ওপেন সিক্রেট। বিষয়টি শুধু তাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, ছড়িয়ে পড়েছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ইউজিসি, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। এমনকি আরও কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও।
বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অফিসিয়াল কার্যাবলির বাইরে দুজনের আলাদা সময় কাটানো, বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন কিংবা শিক্ষা খাতের বাইরে যে কোনো অনুষ্ঠানে হরহামেশা একসঙ্গে অতিথি হওয়া, বিনা নোটিশে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ঢাকা অফিসে নিয়মিত যাতায়াত ছিল ডা. দীপু মনির নিয়মিত রুটিনের একটি। যদিও মন্ত্রীর প্রটোকল অনুযায়ী, তিনি কোথাও গেলে আগে থেকে নোটিশ করার নিয়ম রয়েছে।
শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির সঙ্গে দেশ-বিদেশে চষে বেড়িয়েছেন উপাচার্য মশিউর। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে কলকাতার একটি বইমেলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে যোগ দেন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি। সেখানেও সফরসঙ্গী হন মশিউর। চাঁদপুর জেলা পুলিশের অনুষ্ঠানে দীপু মনি প্রধান অতিথি আর মশিউর থাকতেন বিশেষ অতিথি। তখনকার জেলা পুলিশের এসপি মিলন মাহমুদকে এক অনুষ্ঠানে জেলা আওয়ামী লীগের নেতারা জিজ্ঞেস করেন, কোন প্রটোকলে উপাচার্য মশিউর এ অনুষ্ঠানে অতিথি হয়েছেন। আর আমরাই বা মঞ্চের নিচে কেন। তখন এসপির জবাব, ‘এটা মন্ত্রী মহোদয়ের নির্দেশ।’ ২০২২ সালে চাঁদপুর প্রেস ক্লাব আয়োজিত ফল উৎসবে প্রধান অতিথি হিসেবে দীপু মনির সঙ্গে প্রধান আলোচক হন উপাচার্য মশিউর। দীপু মনির চাওয়া অনুযায়ী তাকে অতিথি করা হয়। একই বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মার্কেটিং বিভাগের বৃত্তি প্রদান অনুষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক আকতারুজ্জামান উপস্থিত না থাকলেও বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকেন মশিউর রহমান। এ ছাড়া দিনাজপুর, নেত্রকোনা, রংপুর, বরিশালসহ দীপু মনি শিক্ষামন্ত্রী থাকা অবস্থায় ঢাকার বাইরের প্রায় সব অনুষ্ঠানেই দীপু মনির ছায়া সঙ্গী হিসেবে উপস্থিত থাকতেন মশিউর। যে কারণে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য উপাচার্যকে পাত্তা দিতেন না তিনি। তার দাপটে সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা থাকতেন কোণঠাসা।
২০২৪ সালে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর মন্ত্রণালয় বদল হয়ে সমাজকল্যাণে দায়িত্ব পান দীপু মনি; কিন্তু সঙ্গ পরিবর্তন হয়নি তাদের। সমাজকল্যাণমন্ত্রী হিসেবে কুড়িগ্রামের একটি অনুষ্ঠানে দীপু মনি প্রধান অতিথি হলেও কোনো কারণ ছাড়াই সেখানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত হন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মশিউর রহমান। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, শিক্ষামন্ত্রীর অধিকাংশ অনুষ্ঠানে অধ্যাপক মশিউরের অপ্রাসঙ্গিক উপস্থিতি বা অতিথি হওয়া ছিল দৃষ্টিকটু। শেষের দিকে তো দীপু মন্ত্রীর অনুষ্ঠানে অধ্যাপক মশিউর অতিথি হওয়া রীতি হয়ে উঠেছিল।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়র সূত্রগুলো জানায়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানগুলোর অধিকাংশই আয়োজন করা হতো আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে। মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট ছাড়াও ধানমন্ডিতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আঞ্চলিক অফিসে বসে শিক্ষা প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ অনেক সিদ্ধান্ত নেওয়া হতো। কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কে হবেন, কাকে কোথায় বদলি করতে হবে—এমন সিদ্ধান্ত আসত এ দুটি অফিস থেকে। এসব কাজে মোটা অঙ্কের আর্থিক লেনদের অভিযোগও রয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) একাধিক কর্মকর্তা জানান, দীপু মনি শিক্ষামন্ত্রী থাকাকালীন ইউজিসির সঙ্গেও নানা বিবাদে জড়িয়েছেন অধ্যাপক মশিউর। ইউজিসির বাধা সত্ত্বেও শিক্ষামন্ত্রীর প্রভাব খাটিয়ে বাজেট বৃদ্ধি, অন্য ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থী ভর্তিসহ নানা কার্য সম্পাদন করেছেন তিনি। ইউজিসির এক কর্মকর্তা বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অন ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থী ভর্তির বিষয়ে নিষেধ করেছিল ইউজিসি। তবে সেই নিষেধাজ্ঞার থোরাই কেয়ার করেছেন অধ্যাপক মশিউর। ডা. দীপু মনির সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকায় আমাদের নির্দেশনা না মেনে তিনি শিক্ষার্থী ভর্তি করেছিলেন। দুই শতাধিক শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন অনিশ্চয়তায় ফেলে দিয়েছিলেন তিনি।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যাপক ড. মশিউর রহমান কালবেলাকে বলেন, ‘জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানের উপাচার্য হওয়ায় শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখতে হয়েছিল। মন্ত্রী নানান বিষয়ে মাকসুদ কামাল (ঢাবির সাবেক উপাচার্য) ভাই এবং আমিসহ অনেকের সঙ্গে পরামর্শ করতেন। তবে শিক্ষাঙ্গনে আমার কোনো প্রভাব ছিল না। আমি কোথাও কোনো অনিয়ম বা দুর্নীতির সঙ্গেও জড়িত ছিলাম না। কেউ বিন্দুমাত্র অভিযোগ প্রমাণ করতে পারলে আমি সাধুবাদ জানাব।’
দেশ-বিদেশে মন্ত্রীর সফরসঙ্গী হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ২ হাজার ২৫৭টি কলেজ রয়েছে। এর মধ্যে আমি ৫০টি কলেজও পরিদর্শন করতে পারিনি।’ সমাজকল্যাণমন্ত্রী দীপু মনির সঙ্গে কুড়িগ্রাম সফরের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এটি ছিল বঙ্গবন্ধু মুক্তিযোদ্ধা গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে যাদুঘরের উদ্বোধন। সেখানে অনেক আগেই অতিথি হিসেবে থাকার অনুরোধ ছিল এবং আমি যাই।’ সাংবাদিকদের ফল উৎসবে অতিথি হওয়া প্রসঙ্গে সাবেক এই উপাচার্য বলেন, ‘ওই দিন অন্য আট-দশটি অনুষ্ঠানের ফাঁকে সেখানে আমি অংশ নিই। আর ইউনেস্কোর বাইরে বিশেষ আমন্ত্রণে কলকাতায় একটি অনুষ্ঠানে অংশ নিই।’
সূত্র: কালবেলা
No comments:
Post a Comment