Sunday, June 15, 2025

তালসরা দরবারের দুই কোটি টাকা ‘লুট’- নাটক সাজিয়েছিলেন জিয়াউল-সোহায়েল। (BDC CRIME NEWS24)

BDC CRIME NEWS24

তালসরা দরবারের দুই কোটি টাকা ‘লুট’-

নাটক সাজিয়েছিলেন জিয়াউল-সোহায়েল:

প্রকাশ : ১৫ জুন ২০২৫, ০৮: ৫৭

দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ইতিহাসে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বা ক্রসফায়ারের ঘটনা নতুন কিছু নয়। তবে একসময়ের র‌্যাব-৭ অধিনায়ক হাসিনার সরকারের আদেশে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ক্রসফায়ারে রাজি হতে অস্বীকার করায় তার এবং তার টিমের পরিণতি হয়েছিল ভয়াবহ।

মামলার নথি থেকে জানা গেছে, ২০১১ সালের ৪ নভেম্বর সন্ধ্যায় চট্টগ্রামের তালসরা দরবারে অভিযান চালিয়ে র‌্যাব-৭-এর সদস্যরা মিয়ানমারের পাঁচ নাগরিককে গ্রেপ্তার করে। পাঁচ মাস পর নতুন এক নাটকে মোড় নেয় সে ঘটনা। তখনকার ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ জুলফিকার আলী মজুমদার, কোম্পানি কমান্ডার ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শেখ মাহমুদুল হাসান এবং কয়েকজন র‌্যাব সদস্যের বিরুদ্ধে সে মাজারের আলমারি থেকে দুই কোটি সাত হাজার টাকা লুটের অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনায় ২০১২ সালের ১৩ মার্চ আনোয়ারা থানায় র‌্যাব সদস্যসহ ১২ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়।

র‌্যাবের শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মাজার থেকে কোটি টাকা লুটের অভিযোগ তখন বেশ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। আমার দেশ ১৩ বছর আগের সে ঘটনাটি অনুসন্ধান করেছে এবং এতে উঠে এসেছে ভিন্ন তথ্য।

কী ঘটেছিল

মামলার নথি থেকে জানা গেছে, মামলাটি হয় তালসরা দরবার থেকে টাকা লুটের অভিযোগে। ২০১২ সালের ২৬ জুলাই র‌্যাব-৭-এর তখনকার অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল জুলফিকারসহ সাতজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেন আনোয়ারা থানার পরিদর্শক (তদন্ত) ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আবদুস সামাদ।

মামলার অন্য অভিযুক্তরা হলেন— ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শেখ মাহমুদুল হাসান, র‌্যাব-৭-এর সাবেক ডিএডি আবুল বাশার, এসআই তরুণ কুমার বসু, র‌্যাবের তিন সোর্স দিদারুল আলম ওরফে দিদার, আনোয়ার মিয়া ও মানব বড়ুয়া।

দরবারের পীরের গাড়িচালক মোহাম্মদ ইদ্রিসের করা মামলার অভিযোগে বলা হয়, লেফটেন্যান্ট কর্নেল জুলফিকারের নেতৃত্বে র‌্যাবের একটি দল অভিযান চালিয়ে দরবারের আলমারি ভেঙে দুই কোটি সাত হাজার টাকা নিয়ে যায়। ওইদিন দরবার থেকে মিয়ানমারের পাঁচ নাগরিককে র‌্যাব সদস্যরা আটক করে। থানায় নিয়মিত মামলা করে তাদের হস্তান্তর করা হলেও টাকার বিষয়ে কোনো কিছু উল্লেখ করেনি র‍্যাব। উল্লেখ্য, ওই আসামিরা বিভিন্ন মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত হয়েছেন। পরে চট্টগ্রামের পঞ্চম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ নুরে আলম ভুঁইয়ার আদালতে অভিযোগপত্রভুক্ত সাত আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন হয়।

এ বিষয়ে র‌্যাব-৭-এর সাবেক অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল জুলফিকার আমার দেশকে বলেন, ‘বাস্তবে কোনো টাকা লুট হয়নি। বরং, সেই অভিযানে অবৈধভাবে বসবাসরত মিয়ানমারের পাঁচজন নাগরিককে গ্রেপ্তার করে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছিল।’

প্রশ্ন হলো, তাহলে কেন এ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে এমন ভয়াবহ অভিযোগ ওঠেÑ এমন প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে উঠে এসেছে সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্ত হওয়া কুখ্যাত জিয়াউল আহসানের নীলনকশার বিষয়।

ক্রসফায়ারের তালিকা পাঠান জিয়াউল

লেফটেন্যান্ট কর্নেল জুলফিকার আমার দেশকে বলেন, ‘র‌্যাব সদর দপ্তর থেকে আমাকে একটি তালিকা পাঠান তখনকার র‍্যাব ইন্টেলিজেন্স উইংয়ের পরিচালক (বর্তমানে গ্রেপ্তার) জিয়াউল। সেখানে চট্টগ্রামের বিএনপি-জামায়াতের কয়েকজন নেতাকে দ্রুত ক্রসফায়ারের নাটক সাজিয়ে হত্যার নির্দেশ ছিল। কিন্তু আমি সেই অনৈতিক কাজ করতে অপারগতা প্রকাশ করি। এতে হাসিনার ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত জিয়াউল এবং আওয়ামী লীগের কিছু প্রভাবশালী নেতা আমাকে র‌্যাব থেকে সরানোর পরিকল্পনা করতে থাকে। পরবর্তী সময়ে আমাকে এবং আমার ব্যাটালিয়নের কোম্পানি কমান্ডারসহ র‍্যাব-৭-এর ৯ সদস্যকে চট্টগ্রামের একটি মাজার থেকে টাকা লুটের সাজানো মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়া হয়।’

র‌্যাব-৭-এর সাবেক অধিনায়ক আরো বলেন, ‘অপরাধ প্রমাণিত না হওয়া সত্ত্বেও জিয়াউল তৎকালীন সরকারের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল তারেক সিদ্দিকির প্রভাব খাটিয়ে নিজ নিজ বাহিনী থেকে কেবল প্রশাসনিক আদেশের মাধ্যমে আমাকে বরখাস্ত ও ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মাহমুদকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠায়। এ ছাড়া ডিএডি বাসার ও এসআই তরুণকেও বরখাস্ত করা হয়।’

অভিযোগের বিষয়ে র‍্যাব-৭-এর সাবেক কোম্পানি কমান্ডার ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মাহমুদুল আমার দেশকে বলেন, ‘সাজানো সে ঘটনার তদন্তকালে জিয়াউল আমাদের কাছে ৫০ লাখ টাকা দাবি করেন। আমরা টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে আমাদের ওই মিথ্যা, বানোয়াট, ষড়যন্ত্রমূলক মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়।’

এদিকে মামলায় মাজারের আলমারি থেকে দুই কোটি টাকা লুটের কথা বলা হলেও সেই টাকার হদিস আর মেলেনি।

এ বিষয়ে র‍্যাব-৭-এর সাবেক কোম্পানি কমান্ডার বলেন, ‘এটি ষড়যন্ত্রমূলকভাবে তৈরি করা হয়েছিল। কথিত দুই কোটি টাকার উৎস এবং জব্দ তালিকায় কোনো কিছু তারা দেখাতে পারেনি। আমরা অবৈধভাবে বসবাসরত বিদেশি নাগরিক এবং দেশীয় অস্ত্র ছাড়া অন্য কিছু পাইনি।’

নির্যাতন ও মিথ্যা স্বীকারোক্তি

এই মামলায় আসামিদের নির্যাতন করে মিথ্যা স্বীকারোক্তি নেওয়া হয়েছিল বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।

র‌্যাব-৭-এর সাবেক অধিনায়ক জুলফিকার বলেন, ‘ফ্যাসিস্ট হাসিনার শাসনামলে মেজর জেনারেল জিয়াউল এবং রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েল (তৎকালীন র‍্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক) কর্তৃক অবৈধ, অন্যায় এবং অনৈতিক আদেশ (গুম, খুন ইত্যাদি) অমান্য করার জন্য নির্যাতিত, নিপীড়িত, শোষিত এবং বঞ্চিত হন দেশপ্রেমিক ও সৎ সামরিক কর্মকর্তারা। জিয়াউলের ক্রোধ এবং ক্ষমতার দাপট এতটাই বেশি ছিল যে, তিনি ওই অভিযান দলের সবাইকে চাকরিচ্যুত করেই ক্ষ্যান্ত হননি, বরং হয়রানি ও ষড়যন্ত্রমূলক মামলা এবং হামলার মাধ্যমে নির্যাতন চালিয়েছেন।’

লেফটেন্যান্ট কর্নেল জুলফিকার বলেন, ‘তখন প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে যে সংবাদ প্রচার করা হয়েছিল, তা সম্পূর্ণ মিথ্যা, ভিত্তিহীন, বানোয়াট এবং ষড়যন্ত্রমূলক; যা কি না তৎকালীন র‍্যাব ইন্টেলিজেন্স এবং লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালকদ্বয় সম্পূর্ণ অসৎ উদ্দেশ্যে র‍্যাব-৭-এর সাবেক কর্মকর্তাদের হয়রানি ও সুনাম ক্ষুণ্ণ করার জন্য দিয়েছিলেন। জিয়াউলের অত্যাচারে ওই অভিযান দলের দুই কর্মকর্তাসহ অন্যান্য পদবির ব্যক্তিরা স্বাভাবিকভাবে জীবনযাপন করতে পারেনি।’

মামলার আরেক আসামি সুবেদার আবুল বাশার আমার দেশকে বলেন, ‘মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আব্দুস সামাদের ফোনে জিয়াউল ফোন করে আমাকে ধমক দিয়ে বলেছিলেন, স্বীকারোক্তি না দিলে আমার ছেলেকে অপহরণ করা হবে। আমার ছেলে তখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ত। পরে সাদা কাগজে স্বাক্ষর নেয় তারা। আমাদের র‌্যাব-১-এর গোপন কারাগারে ২০-২২ দিন আটকে রাখা হয়েছিল। রাতে আমাদের জমটুপি পরিয়ে বাইরে নিয়ে ক্রসফায়ারের ভয় দেখানো হতো।’

মামলার অন্য আসামি এসআই তরুণ কুমার আমার দেশকে বলেন, ‘মাজারে মিয়ানমারের পাঁচ নাগরিককে গ্রেপ্তারের চার মাস ২৭ দিন পর উল্টো আমাদের বিরুদ্ধে ডাকাতি মামলা করায় জিয়াউল। মাত্র একদিনে আমাদের ডিসচার্জ করেছে। এর আগে আমাদের র‌্যাব-১-এর গোপন কারাগারে গুম রাখে। আদালত আমাদের পক্ষে রায় দিয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষে আপিল করায় সব আটকে আছে। আমাদের ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে সাদা কাগজে জবানবন্দি আদায় করা হয়েছিল। এমনকি জবানবন্দি লেখা ম্যাজিস্ট্রেটকে আমি কখনো দেখিনি।’

তদন্তে কী মিলেছিল

জানা গেছে, মাজার লুটের ঘটনায় পাঁচটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। এর মধ্যে র‍্যাব, সেনাবাহিনী, বিমান বাহিনী, বিজিবি এবং পুলিশ নিজ নিজ সদস্যদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ তদন্তে কমিটি গঠন করেছিল।

উল্লেখ্য,‌ র‍্যাবের তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করেছিলেন তৎকালীন র‍্যাব ইন্টেলিজেন্স উইংয়ের পরিচালক জিয়াউল ও তার অধীনস্তরা। র‌্যাব সদর দপ্তর থেকে করা প্রাথমিক তদন্তে টাকা লুটের ঘটনায় র‌্যাব সদস্যদের জড়িত থাকার বিষয়টি ধরা পড়ে। কিন্তু অন্যান্য তদন্তে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ হয়নি।

লেফটেন্যান্ট কর্নেল জুলফিকার বলেন, ‘একই ঘটনায় আমার বিরুদ্ধে দুদক একটি অনুসন্ধান করে, যাতে এ অভিযোগের সঙ্গে কোনো সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি। পরবর্তী সময়ে মামলার বাদী মামলাটি তুলে নেওয়ার জন্য আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। বিনিময়ে তিনি কিছু অর্থ দাবি করেছিলেন। কিন্তু আমরা তার সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করি। বঞ্চিত কর্মকর্তারা প্রাতিষ্ঠানিক, সামাজিক এবং পারিবারিকভাবে হয়রানির শিকার হয়েছেন।’

এ বিষয়ে র‍্যাব-৭-এর সাবেক কোম্পানি কমান্ডার বলেন, ‘এমন অনেক মিথ্যা, বানোয়াট এবং ষড়যন্ত্রমূলক ঘটনার মাধ্যমে জিয়াউল এবং এম সোহায়েল বাহিনীর অনেক কর্মকর্তার কেবল ক্ষতিগ্রস্তই করেননি, বরং বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর গৌরবোজ্জ্বল সুনাম এবং ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুণ্ণ করেছেন। আমরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং আইনের মাধ্যমে ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করি। আমরা নিজ নিজ বাহিনী থেকে আমাদের হারানো সম্মান ও মর্যাদা ফেরত চাই।’

ডিএডি বাশার এবং এসআই তরুণ বসাক নিজ নিজ বাহিনীতে বিভাগীয় মামলায় জিতেছেন। কিন্তু এখনো তাদের নিজ বাহিনীতে যোগ দিতে দেওয়া হয়নি।

লুটের বিষয়ে সেই দরবারের পীরের এক ছেলে ব্যারিস্টার মোহাম্মদ মামুন আমার দেশকে বলেন, র‌্যাব কর্মকর্তারা দরগার আলমারি ভেঙে টাকা লুট করেছিল। এ মামলা চলছে।

উল্লেখ্য, মাজার লুটের নাটক সাজানোর ক্রীড়নক জিয়াউলকে গত ১৫ আগস্ট মধ্যরাতে রাজধানীর খিলক্ষেত এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এর পাঁচদিন পর নৌবাহিনী থেকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো চট্টগ্রাম বন্দরের সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) মোহাম্মদ সোহায়েলকে বনানী থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, জোরপূর্বক গুম ও জুলাই গণঅভ্যুত্থানকালে গণহত্যাসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে। দুইজনই বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন।

সূত্র: আমার দেশ 

No comments:

Post a Comment

এনএসআইয়ে ‘র’ নেটওয়ার্ক। (BDC CRIME NEWS24)

BDC CRIME NEWS24 এনএসআইয়ে ‘র’ নেটওয়ার্ক: প্রকাশ : ১৯ আগস্ট ২০২৫, ০৮: ২৭ বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআইয়ের অভ্যন্তরে ২০০৯ ...