BDC CRIME NEWS24
দিয়াবাড়িতে ‘অস্ত্র উদ্ধার’ ছিল সাজানো নাটক:
প্রকাশ : ১১ মার্চ ২০২৫, ১১: ১৩
সবুজে ঘেরা কোলাহলমুক্ত ঢাকার উত্তরার দিয়াবাড়ির খালে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র উদ্ধারের যে নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিল, ৮ বছর পার হলেও তার তদন্ত হয়নি। পুলিশ ওই সময় দাবি করেছিল, চট্টগ্রামে ১০ ট্রাক অস্ত্র জব্দের পর দিয়াবাড়ির অস্ত্র জব্দের ঘটনাটি ছিল দ্বিতীয় বড় অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনা।
কিন্তু ওই অস্ত্রগুলো কারা এবং কীভাবে খালে ফেলে গেছে, পুলিশ সে সময় কোনো সুনির্দিষ্ট উত্তর দেয়নি। তখন পুলিশ গতানুগতিক বক্তব্য দেয়। সে সময় বাহিনীটি বলেছিল, দেশকে যারা নাশকতা করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিঘ্ন ঘটাতে চায়, তারা সেখানে অস্ত্র ফেলে গেছে। শুধু তা-ই নয়, সংস্থাটি আরো জানায়, যারা মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে দেখতে চায় না, তারা সেখানে অস্ত্র ফেলে গেছে। কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠী অস্ত্রগুলো খালে ফেলে পালিয়ে গেছে।
তবে মূল ঘটনা হলো, তৎকালীন ঢাকা মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে সে সময়ের ওই অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনাটি পুরোপুরি আড়াল করার চেষ্টা করা হয়েছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ওই অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনাটি ছিল সম্পূর্ণ সাজানো। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ও ডিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) পক্ষ থেকে সেই সাজানো নাটক আয়োজন করা হয়।
ওই নাটকটির মূল দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল সিটিটিসির আর্মস ও ডগ স্কোয়াড বিভাগকে। ওই অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনাটি ভিন্ন খাতে প্রভাবিত করতে বিরোধী দলের ওপর দায় চাপানোর চেষ্টা করার প্রক্রিয়া করেছিল পুলিশ। কিন্তু সেটি হালে পানি পায়নি। ওই ঘটনার মূল মাস্টারমাইন্ড তৎকালীন ডিএমপি কমিশনার (বর্তমানে কারাগারে) মো. আছাদুজ্জামান মিয়া।
তার সময় ঢাকায় বিএনপি-জামায়াতসহ বিরোধী দলের ওপর চরম নির্যাতন-নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছিল। কথিত আগুনসন্ত্রাস দমনের নামে ঢাকায় এলাকা ভাগ করে ব্লক রেইড দেওয়া হয়। ব্লক রেইডে অনেককেই থানায় নিয়ে গিয়ে পঙ্গু করার অভিযোগ আছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই সময়ে দায়িত্ব পালনকারী ডিএমপির একজন এডিসি জানান, ৭ দিন আগে থেকে আছাদুজ্জামান মিয়া ওই পরিকল্পনা করেন। বিষয়টি শুধু ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম, আনোয়ার হোসেন ও ব্যারিস্টার মাহবুবুর রহমান জানতেন। নিচের কর্মকর্তারা বিষয়টি জানতেন না। জানা গেছে, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে ওই ঘটনার পূর্ণ তদন্ত শুরু করবে সিটিটিসি। সেটির জন্য তারা হোমওয়ার্ক শুরু করেছে। সে সময়ে দায়ের হওয়া জিডি ও কাগজপত্র তারা সংগ্রহের উদ্যোগ নিয়েছে বলে সিটিটিসি নিশ্চিত করেছে।
২০১৬ সালের ১৮, ১৯ ও ২৫ জুন তিন দফায় উত্তরার দিয়াবাড়ির ১৬ নম্বর সেক্টরের খাল থেকে বিপুল পরিমাণের কথিত অস্ত্র উদ্ধার করে পুলিশ। ১৮ জুন খাল থেকে ৭টি কালো ব্যাগ উদ্ধার করা হয়। সেই ব্যাগ থেকে ৯৫টি এমএল পিস্তল, ৪৬২টি ম্যাগাজিন, এক হাজার ৬০টি গুলি ও ১০৪টি স্প্রিংযুক্ত বাক্স উদ্ধার করে। আবার ১৯ জুন তার পাশেই আরেকটি খাল থেকে ৩২টি ম্যাগাজিন, ৮টি ক্লিনিং রড ও ২৫ জুন তৃতীয় দফায় ৩২৫টি রুপালি ও সবুজ রঙের স্প্রিংযুক্ত বাক্স উদ্ধার করে। ওই বাক্স থেকে ৫টি ওয়াকিটকি, দুটি ট্রান্সমিটার, দুটি ফিডার ক্যাবল, ৭ প্যাকেট বিস্ফোরক জেল উদ্ধার করা হয়। পুলিশ দাবি করেছিল, নম্বরবিহীন একটি কালো জিপ থেকে খালে অস্ত্রগুলো ফেলে রেখে গেছে। তবে ওই গাড়ি এখনো চিহ্নিত করতে পারেনি পুলিশ।
জানা গেছে, অধিকাংশ অস্ত্রই ছিল মরিচা পড়া এবং ব্যবহারের অযোগ্য। দেখে মনে হয়েছে, দীর্ঘদিন ধরে ডাম্পিংয়ে পড়ে ছিল সেগুলো। সেখান থেকে অস্ত্রগুলো তুলে এনে কেউ ফেলে রেখে গেছে। সেই অস্ত্র উদ্ধারের নাটকের জন্য বেছে নেওয়া হয়েছিল নির্জন ও কোলাহলমুক্ত এলাকা। সন্ধ্যা হলেই সেখানে লোকজনের আনাগোনা কমে যায়। মানুষজন তেমনটা চলাচল করে না। এমন এলাকায় এতগুলো অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনাটি নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে।
অস্ত্র উদ্ধার নাটকের সময় সেখানে গিয়েছিলেন তৎকালীন দাপুটে পুলিশ কর্মকর্তা ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া। তিনি সাংবাদিকদের জানান, বড় ধরনের নাশকতা ঘটাতেই অস্ত্র ও গোলাবারুদ খালে মজুত করা হয়েছিল। যারা বাংলাদেশের অগ্রগতি চায় না, তারা সেখানে অস্ত্র ফেলে রেখে গেছে। জানা গেছে, ওই ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে থানায় কোনো মামলা দায়ের করা হয়নি। তুরাগ থানায় তিনটি জিডি (সাধারণ ডায়েরি) করা হয়েছিল। এত বড় ঘটনা আড়াল করতেই মূলত এই কাজ করা হয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে।
যে সময় অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছিল, ওই সময় চারদিক ছিল সবুজ-শ্যামল। তবে গত রোববার সরেজমিনে দেখা গেছে, সেই সবুজ-শ্যামল কিছুটা কমেছে। উঠেছে বড় বড় দালান। লোকজনের আনাগোনাও বেড়েছে। সড়ক পাকা হয়েছে। সড়কে বৈদ্যুতিক বাতি বসানো রয়েছে। তবে সেই খাল এখনো রয়ে গেছে। খালের পাশে দুটি টিনের বাড়ি রয়েছে।
সেই বাড়িতে একটি বাড়ির কেয়ারটেকার থাকেন। অস্ত্র উদ্ধারের এতদিন হয়ে গেলেও আশপাশের লোকজন বিষয়টি মনে রেখেছেন। কেউ আবার ঘটনাটি নিয়ে উপহাসও করেছেন। কয়েকজন আবার এ ঘটনার পর পুলিশি হয়রানির ভয়ে আতঙ্কে এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন।
আজমত আলী নামে এক তত্ত্বাবধায়ক জানান, ৮ বছর আগে আশপাশে জায়গাটি সবুজ-শ্যামল ছিল। ভুট্টা ও টমেটোর চাষ হতো। লোকজনের আনাগোনা কম ছিল। তিনি আরও জানান, হঠাৎ অনেক পুলিশ এসে বলে এই খালে প্রচুর অস্ত্র আছে। এরপর তারা খালের একপাশ থেকে অস্ত্র উদ্ধার শুরু করে।
দিয়াবাড়ির নিরাপত্তারক্ষী সেলিম জানান, খালের অদূরে একটি গ্যারেজে তিনি কাজ করতেন। অস্ত্র উদ্ধারের সময় আশপাশের লোকজন পুলিশি হয়রানির ভয়ে আতঙ্কে এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন। পুলিশ অস্ত্রের ব্যাপারে আশপাশের লোকজনকে ‘কথিত জিজ্ঞাসাবাদ’ করেছে।
দিয়াবাড়ির বৌদ্ধ মন্দিরের সুনীল ভিক্ষু বলেন, ঘটনার সময় আমি মন্দিরেই ছিলাম। সেদিন অনেক অস্ত্র উদ্ধার করতে দেখেছি। সেই অস্ত্রগুলো ছিল পুরোনো। এতগুলো অস্ত্র খালে কীভাবে এলো, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ওই ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি। সংশ্লিষ্ট তুরাগ থানায় তিনটি জিডি হয়েছিল। জিডির বাদী হয়েছিল পুলিশ নিজেই। সেই জিডিগুলোর আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে পুলিশ। তবে প্রতিবেদনে কারা ও কীভাবে অস্ত্রগুলো সেখানে এলো, সে ব্যাপারে কিছু বলা হয়নি।
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (সিটিটিসি) মাসুদ করীম রোববার আমার দেশকে বলেন, ‘বিষয়টি আমার নলেজে নেই। প্রয়োজনে আবার তদন্ত শুরু হবে।’
সূত্র: আমার দেশ
No comments:
Post a Comment