Monday, January 13, 2025

কাঁদতে কাঁদতে মায়ের চোখের পানি শুকিয়ে যায়। (BDC CRIME NEWS24)

BDC CRIME NEWS24

কাঁদতে কাঁদতে মায়ের চোখের পানি শুকিয়ে যায়:

প্রকাশ : ১৩ জানুয়ারি ২০২৫, ০৮: ৫২

হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশসহ বিভিন্ন কারণে বেশ আলোচিত ছিল চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদরাসা এলাকা। বিগত আওয়ামী সরকারের দমন-নির্যাতনেরও তাই অন্যতম টার্গেট ছিল ওই এলাকার মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকরা।

ধর্মীয় ইস্যুতে যাতে কোনো প্রতিবাদ-বিক্ষোভ গড়ে উঠতে না পারে, সে জন্য সার্বক্ষণিক গোয়েন্দা নজরদারি আর পুলিশি হয়রানি ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। এমনই নজরদারির একপর্যায়ে বিনা অপরাধে গ্রেপ্তার হন হাটহাজারীর মারকাজুল কোরআন ইসলামিক একাডেমির পরিচালক মাওলানা এমরান সিকদার।

নিজ প্রতিষ্ঠানে আসরের নামাজের জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার সময় খুব অপমানজনকভাবে তাকে আটক করে ডিবি পুলিশ। জামা-জুতা পরার সুযোগ না দিয়েই সন্ত্রাসী কায়দায় ধরে নিয়ে যায় একজন রোজাদার আলেমকে। চার দিন রিমান্ডে মানসিক নির্যাতন ছাড়াও একে একে ১৩টি মামলা দিয়ে ১০ মাস কারারুদ্ধ করা হয় হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ, হাটহাজারী উপজেলার এই সাধারণ সম্পাদককে। জেলজীবনে নিজের কষ্টের প্রভাব পড়ে শিশুসন্তান, বৃদ্ধা মাসহ পরিবারের সদস্যদের ওপর।

আওয়ামী শাসনামলের সেসব কালো দিনগুলোরর কথা স্মরণ করে মাওলানা এমরান সিকদার বলেন, আওয়ামী সরকারের পুরো আমলে আলেম-ওলামা এবং হেফাজতে ইসলামের দায়িত্বে থাকা নেতারা সবসময় আতঙ্কে থাকতাম। কিছুদিন পর পুলিশ আমাদের মাদরাসায় গিয়ে নানা বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করত। সেখানে কত ছাত্র আছে, কত টাকা খরচ হয়, এ টাকা কোথা থেকে পান ইত্যাদি বিষয়ে খোঁজখবর নিত। আলেম-ওলামা ও মাদরাসাগুলোয় সবসময় গোয়েন্দা নজরদারি থাকত।

দীর্ঘ ১৪ বছর হাটহাজারীর একটি মাদরাসার শিক্ষক ছিলেন মাওলানা এমরান সিকদার। পরে মারকাজুল কোরআন ইসলামিক একাডেমি নামে নিজে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। বর্তমানে সেখানেই পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। এ ছাড়া ইসলামিক ফাউন্ডেশনের গণশিক্ষার একটি শাখা ছিল তার মাদরাসায়। কিন্তু হেফাজতের ঘটনায় ধরপাকড়ের সময় তাকেও পুলিশ গ্রেপ্তার করে, এতে ওই কেন্দ্রটি বন্ধ করে দেওয়া হয়।

২০২১ সালের ২৩ এপ্রিল গ্রেপ্তার হন এই আলেম। সেই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ১০ রমজানের দিন বিকালে নিজের মাদরাসায় আসরের নামাজের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। হঠাৎ পুলিশ এসে মাদরাসার চারপাশ ঘেরাও করে ফেলে। আমি অজু করে বের হয়েছি মাত্র।

গেঞ্জি ও লুঙ্গি পরা ছিলাম। এমন সময় আমাকে নিয়ে যেতে চায় পুলিশ। আমি পাঞ্জাবিটা গায়ে দেওয়ার জন্য সময় চাইলে তারা বলে, জামা-টামা পরা যাবে না। বের হওয়ার সময় দরজার পাশে জুতাটা পরতে চেয়েছি, তাও পরতে দেয়নি। এভাবে খালি পায়ে, গেঞ্জি-লুঙ্গি পরা অবস্থায় আমাকে ডিবি কার্যালয়ে আনা হয়। রাত একটা/দেড়টা পর্যন্ত বসিয়ে রাখে। সেখানেই ইফতার ও সাহরি সারি। পরে পাঁচলাইশ থানায় আমাকে সোপর্দ করা হয়।

মাওলানা এমরান সিকদার বলেন, পাঁচলাইশ থানায় রাতে আমাকে এমন দুটি কম্বল দেয়, যা খুবই অপরিচ্ছন্ন। পরিবেশটা ছিল খুবই নোংরা। মশার যন্ত্রণায় ঘুমানোর সুযোগ ছিল না। এভাবে বসেই রাত কাটিয়ে দিই। পরের দিন দুপুর দেড়টা/দুটার দিকে আমাকে জেলে পাঠায়। প্রথমে তিনটা মামলায় জড়ানো হয় তাকে। কী মামলা দেওয়া হয়েছে, তা ওই সময় জানতাম না। সেই মামলায় চার/পাঁচ মাস জেলে থাকার পর পর্যায়ক্রমে ১৩টি মামলা দেওয়া হয়।

পুলিশের ওপর হামলা, ভাঙচুরসহ এমন কোনো ধারা নেই, যাতে মামলা দেয়নি। আটকের পরই চার দিনের রিমান্ডে নেয় পুলিশ। দুটি মামলায় দুদিন করে এই রিমান্ড নেওয়া হয়। তিনি বলেন, হাটহাজারী এলাকায় কোনো সমস্যায় পড়লে মাদরাসার শিক্ষকদের পরামর্শ নিতে ডাকত পুলিশ। ২৬ মার্চ মোদিবিরোধী আন্দোলন ঘিরে হাটহাজারীতে যে ঘটনা ঘটে, সেদিন তিনি ও হেফাজতের অন্য অনেক দায়িত্বশীল গ্রামের বাড়িতে ছিলেন।

মাদরাসার ছাত্ররা হঠাৎ বের হয়ে যখন রাস্তায় আন্দোলন করছিল, তখন ইটপাটকেল নিক্ষেপের অভিযোগে গুলি করা শুরু করে পুলিশ। তাদের গুলিতে ঘটনাস্থলেই চার ছাত্র নিহত হন। অথচ তাদের আন্দোলন ঠেকাতে টিয়ারশেল বা অন্য পদক্ষেপ নিতে পারত। সরাসরি রাইফেলের গুলি দিয়ে মানুষ হত্যার তো কোনো যুক্তি নেই।

এমরান সিকদার বলেন, চার ছাত্র নিহতের ওই সময় থানা থেকে পুলিশ আমাকে ফোন দেয়, ছাত্ররা থানায় হামলা করেছে। তখন কী করতে হবে আমি জানতে চাইলে ওসি কিছু বলেনি। পরে এনএসআইয়ের একজন ফোন দিয়ে কী করা যায় জানতে চান। তখন আমি বলি, আপনারা এভাবে মারমুখী না হয়ে আমাদের দায়িত্বশীলদের ব্যবহার করেন।

তখন আমাকে সেখানে যেতে বলেন। তার ডাকে বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে আমি সেখানে যাই। তার আগে দুই-আড়াইটার মধ্যেই সেখানে হতাহতের সব ঘটনা ঘটে। অথচ পরে সব ঘটনায় আমাকে আসামি বানায় পুলিশ। আমরা পুলিশের ফোন পেয়ে তাদের সহযোগিতা করতে সেখানে গিয়েছিলাম অথচ আমাদেরই মামলার আসামি করে পুলিশ। জেলে ও রিমান্ডে আমাদের চরম কষ্ট করতে হয়েছে।

তিনি বলেন, রিমান্ডে জিজ্ঞাসা করত যে, আপনারা হেফাজতের টাকা কোথা থেকে পান। পুলিশের ওপর এই হামলার জন্য আমরা নাকি জুনায়েদ বাবুনগরী ও মামুনুল হকের সঙ্গে বৈঠক করে পরিকল্পনা নিয়েছি। এভাবে শতভাগ মিথ্যা সব অভিযোগ দেয় পুলিশ। চার দিনের রিমান্ডে মানসিকভাবে নানা টর্চার করে।

রিমান্ড শেষে চট্টগ্রাম কারাগারে পাঠানো হয় তাকে। সেখানেও কষ্টে-দুর্ভোগে দিন পার করেন তিনি। এ প্রসঙ্গে এমরান সিকদার বলেন, আমরা জেলের ভেতরে আরেকটা জেলে থাকতাম। আমাদের কারও সঙ্গে কথা বলতে দিত না। অন্য বন্দিরা সপ্তাহে এক দিন ১০ টাকা দিয়ে কথা বলতে পারত। আমি সাড়ে ৯ মাসের মধ্যে মাত্র তিনবার কথা বলেছি, তাও ১০ মিনিটে ৫০০ টাকা দিয়ে।

কারারক্ষীদের বাড়তি টাকা দিলে অনেক কষ্ট করে তারা আমাদের কথা বলার ব্যবস্থা করে দিত। পরিবারের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাতের কোনো সুযোগ দেয়নি। আমরা চেয়েছিলাম, আমাদের কোর্টে তোলা হোক, তাহলে পরিবারের লোকদের অন্তত একবার দেখতে পাব। কিন্তু করোনার কারণে কোর্টেও ওঠায়নি। প্রথমদিকে ভার্চুয়াল কোর্ট চলে, শেষদিকে সাত-আট মাস পর আমাদের কোর্টে ওঠায়। এভাবে গ্রেপ্তারের সাত মাস পর পরিবারের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পাই।

নতুন মামলায় গ্রেপ্তার ছিল নির্যাতনের আরেক মাধ্যম। এ প্রসঙ্গে এমরান শিকদার বলেন, আমাদের মামলায় সহজে জামিন হতো না। দীর্ঘ সাত-আট মাস পর যখন জামিন পাই, তখন মুক্তির জন্য জেলে গেলে অপেক্ষায় থাকি। কিন্তু বের হওয়ার আগে আমাকে জানায়, আপনার বিরুদ্ধে নতুন মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে, আপনি বের হতে পারবেন না।

এভাবে নতুন মামলা দিয়ে তিনবার জেলগেট থেকে ফেরত দিয়েছে। তিনি বলেন, গ্রেপ্তারের সময় আমার বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছিল তিনটি। ছয়-সাত মাস পর্যন্ত ছিলাম সাতটা মামলা নিয়ে, সর্বশেষ ১৩টি মামলায় জামিন নিয়ে বের হতে হয়। এভাবে প্রায় ১০ মাস পর ২০২২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পান তিনি।

মুক্তির পরও স্বাভাবিক কোনো জীবনযাত্রা ছিল না মাওলানা এমরান সিকদারের। সবসময় গোয়েন্দা নজরদারির মধ্যে থাকতেন তিনি। এমরান সিকদার বলেন, জামিনে মুক্তি পেলেও আমরা নজরবন্দি ছিলাম। মুক্তির সময় আমাদের বলে দেওয়া হয়, আপনাদের মুক্তি দেওয়া হয়েছে শুধু মাদরাসা দেখাশোনা এবং পরিবারকে সময় দেওয়ার জন। যদি বাইরে বের হওয়ার চেষ্টা করেন, তাহলে আবার গ্রেপ্তার করা হবে। পুলিশ সবসময় আমাদের খোঁজখবর রাখত। আমরা সাবধানে চলাফেরা করতাম।

এদিকে ১৩টি মামলায় হাজিরা দেওয়া নিয়েও বেশ ভোগান্তির শিকার হতেন তিনি। প্রতি সপ্তাহে মামলার হাজিরা পড়ত তার। তিনি বলেন, ৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত দু-এক দিন পরপরই আদালতে আমাদের হাজিরার তারিখ পড়ে। প্রথম দুই বছর তো প্রায় প্রতিদিন একটা করে হাজিরা পড়ত। এভাবে পুরো সপ্তাহ, পুরো মাস হাজিরা দিতে দিতে কেটে যেত। এটা ছিল আরেক হয়রানি। আমরা স্বাভাবিক কোনো কাজকর্ম করতে পারতাম না।

দীর্ঘদিন জেলে থাকায় চরম ক্ষতির মুখে পড়েছে তার পরিবারও। তিনি বলেন, গ্রেপ্তারের সময় আমার ছোট ছেলেটার বয়স ছিল ১৮ মাস। জেল থেকে বের হয়ে দেখি ছেলেটা শুকিয়ে গেছে। এত দিন সে ঠিকমতো কোনো কথা বলতে পারেনি। কাঁদতে কাঁদতে আমার মায়ের চোখের পানি শুকিয়ে গেছে। ডাক্তার তাকে চিকিৎসা নিতে বলেছেন।

আমাদের পুরো পরিবারে হাসি কী জিনিস ছিল না। আর আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটা একদম ভেঙে পড়ার অবস্থায় ছিল। ছাত্র অনেক কমে গিয়েছিল, নানা দুরবস্থা ছিল, শিক্ষকরাও ছিলেন ভয়ে। আমি গ্রেপ্তারের পর একজনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, পরে ভয়ে সে পালিয়ে চলে গেছে। এতে মাদরাসায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

এমরান শিকদার বলেন, অর্থনৈতিকভাবে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। সংসার চালানো এবং মামলা চালাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছি।

জেলখানায় কষ্টের পাশাপাশি আলেমদের চরম অপমানও করা হয়েছে। এমদাদ নামের একজন কর্মকর্তা তাকে নানা কটূক্তি করতেন। আমাদের জঙ্গি বলতেন। আমরা জঙ্গি নাÑএ কথা বললে হেফাজত জঙ্গি হিসেবে ডাকত। কারও সঙ্গে কথা বলতে দিত না। এক ওয়ার্ড থেকে আরেক ওয়ার্ডে যেতে দিত না। জামায়াতে নামাজ পড়ানোরও সুযোগ দিত না জেলে।

আমাদের মাদকাসক্ত, চোরাকারবারিদের পেছনে নামাজ পড়তে হতো। হাটহাজারীর সাবেক ওসি রফিক ও আরেকজন কর্মকর্তা রাজিব সবচেয়ে বেশি নির্যাতন করেছেন। আমাকে হাটহাজারী থানায় না নেওয়ায় টর্চার থেকে রক্ষা পেয়েছি। তবে অন্য আলেমদের ওই থানায় নিয়ে সমানে পিটিয়েছে। ওসি রফিকের একটা স্বীকারোক্তি আছে, আমাকে কিছু এজেন্ডা দিয়ে এই হাটহাজারী থানায় পাঠিয়েছে সরকার। সে অনুযায়ী হাটহাজারীতে আলেম-ওলামারা বেশি নির্যাতন হন।

সূত্র: আমার দেশ 

No comments:

Post a Comment

চিকিৎসকের যৌন নির্যাতনের শিকার ২৯৯ নারী-কিশোরী। (BDC CRIME NEWS24

BDC CRIME NEWS24 চিকিৎসকের যৌন নির্যাতনের শিকার ২৯৯ নারী-কিশোরী: প্রকাশ: ০৮ মার্চ ২০২৫, ০৫:৩৯  ফ্রান্সে সাবেক এক সার্জনের বিরুদ্ধে ২৯৯ রোগীক...