BDC CRIME NEWS24
ডান্ডাবেড়ি পরাতে গিয়ে পা রক্তাক্ত করে:
প্রকাশ : ০৩ জানুয়ারি ২০২৫, ০৯: ৪৩
কওমি অঙ্গনের অন্যতম জনপ্রিয় মুফতি সাখাওয়াত হোসাইন রাজী। রাজনৈতিক অঙ্গন ও ধর্মীয় মাহফিলের পাশাপাশি মিডিয়া জগতেও বেশ পরিচিত তরুণ এই আলেম। পতিত আওয়ামী ফ্যাসিবাদের নিপীড়নের থাবা পড়েছিল তার ওপরও। সহজে অনুমতি মিলত না তার ওয়াজ মাহফিলের। এমনকি অনুমতি দিয়েও ভেঙে ফেলা হতো ওয়াজের মঞ্চ। সরকারের ‘নিষিদ্ধ আলেমের’ তালিকায়ও ছিলেন তিনি। এতকিছু করেও তাকে থামাতে না পেরে বেছে নেওয়া হয় গ্রেপ্তার-নির্যাতনের পথ। ৪৭টি মামলার বোঝা দিয়ে দীর্ঘ আড়াই বছর কারারুদ্ধ করে রাখা হয় তাকে। এ সময় পৌনে দুই মাস রিমান্ডের নামে নির্যাতনের শিকার হন তিনি। নির্যাতনের অন্যতম একটি হাতিয়ার ছিল ডান্ডাবেড়ি। আর সেই ডান্ডাবেড়ি পরাতে গিয়ে তার পা রক্তাক্ত করে দেয় পুলিশ। ডান্ডাবেড়ি লাগাতে গিয়ে লোহার কড়াও ঢুকে যায় মাংসে। রিমান্ডে অসুস্থ হয়ে পড়ায় পুলিশের আরও ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা থেকে রক্ষা পান বলে জানান ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব মুফতি সাখাওয়াত হোসাইন রাজী।
মুফতি রাজী আমার দেশকে বলেন, বিগত আওয়ামী লীগের সময়ে সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত হয়েছেন আলেম-ওলামা। মুফতি ফজলুল হক আমিনীকে ২১ মাস গৃহবন্দি করে রেখে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হয়। সে সময় দেশের আলেম-ওলামাসহ ধর্মপ্রাণ মানুষ প্রতিবাদ করার অধিকারও হারিয়েছিল। ২০২১ সালে মোদির আগমনের প্রতিবাদ জানিয়ে জুমার নামাজের পর বায়তুল মোকাররমে একটি কর্মসূচি পালন করতে গেলে দলীয় সন্ত্রাসী ও সাঙ্গপাঙ্গদের দিয়ে মুসল্লিদের ওপর ব্যাপক আক্রমণ করা হয়। সেই সূত্র ধরে হাটহাজারীতে বিক্ষোভ হয়। শান্তিপূর্ণ সেই বিক্ষোভে গুলি করে হাটহাজারী মাদরাসার গেটে চারজনকে শহীদ করা হয়।
এর ধারাবাহিকতায় সারা দেশে আন্দোলন-বিক্ষোভ হয়েছে। প্রত্যেকটি বিক্ষোভে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ হয়েছে, হত্যা করা হয়েছে, টিয়ারশেল নিক্ষেপ করা হয়েছে। যারা গ্রেপ্তার হয়েছেন, তাদের থানায় নিয়ে অমানবিক নির্যাতন করা হয়েছে। বি-বাড়িয়ায় ৬-৭ দিনের আন্দোলনে অন্তত ১৭ জন শহীদ হন। তিনি বলেন, আলেম-ওলামাদের এই নির্যাতনের বিষয়টি জাতির কাছে স্পষ্ট হলেও আমাদের দুঃখ হলো মিডিয়াগুলো সেভাবে কাভার করতে পারেনি। আওয়ামী সরকারের পতনের পর এখন কিছুটা কাজ করা শুরু করেছে। এ ক্ষেত্রে ‘আমার দেশ’ সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে বলে আশা করি।
মোদিবিরোধী আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাপক ধরপাকড়ের সময় ২০২১ সালের পয়লা রমজান গ্রেপ্তার হন লালবাগ মাদরাসার মুহাদ্দিস মুফতি সাখাওয়াত হোসাইন রাজী। গ্রেপ্তারের পরই একের এক মামলা দিয়ে নেওয়া হয় রিমান্ডে। ২৮ রমজান পর্যন্ত টানা রমজান মাস তিনি রিমান্ডে কাটান। প্রথমে ডিবি কার্যালয়ে এক সপ্তাহ রিমান্ডে ছিলেন। সেখান থেকে পল্টন থানার রিমান্ডে, তারপর নেওয়া হয় শাহবাগ থানায়। এরপর নেওয়া হয় মতিঝিল থানায়। সেখানে রিমান্ড শেষে আবার ডিবিতে আনা হয়।
মুফতি সাখাওয়াত বলেন, ‘তাদের (পুলিশের) পরিকল্পনা আরও ভয়াবহ ছিল। ঢাকার প্রত্যেকটি থানায় ঘুরেফিরে রিমান্ডে নিয়ে আমাকে টর্চার করতে চেয়েছিল; কিন্তু আমি অসুস্থ হয়ে পড়ায় জরুরিভিত্তিতে ডিবি থেকে কেন্দ্রীয় কারাগারে হস্তান্তর করে। তিনি বলেন, ‘সারা দিন আমাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হতো। রিমান্ডে আগ্রাসী চেহারা নিয়ে আমার চারপাশে বসত পুলিশ। এমন ধরনের প্রশ্ন করত যে, তা শুধু অবাস্তব-অবান্তরই নয়, প্রশ্নগুলোই ছিল আরেক ধরনের নির্যাতন। প্রশ্ন করার ধরন ও অ্যাটিচিউড দেখে মনে হয়েছিল এখনই তারা আমাকে গিলে খাবে, ক্রসফায়ারে দেবে কিংবা টর্চার করে সারা জীবনের জন্য পঙ্গু করে ফেলবে।’
গ্রেপ্তারের সময়ের কিছু স্মৃতিচারণ করে মুফতি সাখাওয়াত বলেন, ‘পয়লা রমজান চ্যানেল আইতে টকশোতে ছিলাম। সেখান থেকে ফেরার পথে অনুভব করছিলাম আমার পেছনে সন্ত্রাসী ধরনের কেউ ফলো করছিল। তারা আমাকে অ্যাটাক করতে পারে। চালককে দ্রুত বাসায় যেতে বলি। লালবাগ কেল্লার মোড়ের বাসায় এক পা দিয়েই দেখি আগে থেকেই সাদা পোশাকধারীরা অবস্থান করছিল। সেখানে ঢোকার পরই আমাকে আটক করে ফেলে। তারা বলে, তাদের সঙ্গে অফিসে যেতে হবে। ওদের অনেক বড় আয়োজন ছিল, সেটা আগে থেকে আঁচ করতে পারিনি। ইফতারের ঠিক আগ মুহূর্তে আমাকে ধরে সোজা ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে যায়। এরপরই নির্যাতন শুরু হয়।’ তিনি বলেন, ‘১৩ সালের পুরোনো একটি মামলায় প্রাথমিকভাবে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। এরপর রিমান্ড শেষ হয় আর মামলা যোগ হয়, রিমান্ডও যোগ হয়। এভাবে প্রায় পৌনে দুই মাস আমাকে রিমান্ডে রাখা হয়। এভাবে নতুন ১৭টিসহ মোট মামলার সংখ্যা দাঁড়ায় ৪৭টি। বিনা অপরাধে আড়াই বছরের মতো জেল খাটি।’
মামলার অভিযোগগুলো হাস্যকর ছিল উল্লেখ করে মুফতি সাখাওয়াত বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক লুট করা, গাছ কাটা, কোরআন পোড়ানো, দেশকে অস্থিতিশীল করা—এ ধরনের আজগুবি কিছু মামলা ছিল। আদালতে ওঠার আগেই এসব মামলা আসলে জামিনযোগ্য। কিন্তু তখনকার আদালত এমন আচরণ করেছে, যেন আদালতই আমাদের প্রতিপক্ষ। তারা মামলাগুলো শুনতেই রাজি হতো না। হাইকোর্টও আমাদের মামলাগুলো শুনত না। তখন নির্যাতন-নিপীড়নের আরেকটা ধরন ছিল—‘স্টে’ করে দেওয়া। দীর্ঘদিন ধরে মামলা শোনার পর জামিন পেলেও তা স্টে হয়ে যেত।’
জেলজীবন সম্পর্কে এই আলেম বলেন, ‘জেলে সাধারণ বন্দিদের একরকম করে রাখা হয়। কেরানীগঞ্জের কারাগার তো অনেক সুন্দর। সেখানে বিউটিপার্লার পর্যন্ত আছে। পার্ক-খেলার মাঠসহ নানা সুযোগ-সুবিধা আছে। কিন্তু আমাদের জেলে নিয়ে প্রত্যেক বিল্ডিংয়ের নিচতলাকে ‘পানিশমেন্ট সেল’ বলা হয়—সেই সেলে এক রুমে ৪-৫ জন করে রাখা হয়। ২৪ ঘণ্টা তালাবদ্ধ করে রাখা হতো। অথচ অন্য আসামিরা জেলে স্বাধীনভাবে ঘোরাঘুরি করত। আমাদের জন্য এটাই ছিল নির্যাতন। সাধারণ বন্দিদের জন্য যে সুবিধা, তার কিঞ্চিতও আমরা ভোগ করতে পারিনি। উল্টো নানা ধরনের ভয়ভীতি দেখানো হতো।’
মুফতি সাখাওয়াত হোসাইন বলেন, ‘আমার সঙ্গে সবচেয়ে খারাপ যে ঘটনা ঘটেছে, তা হলো আমার বাবা আমার খোঁজে কেরানীগঞ্জ কারাগার, কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগার ঘুরে বেড়িয়েছেন। কারা কর্তৃপক্ষ স্বীকারই করেননি আমি কোথায় আছি। একসময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ল যে, মুফতি সাখাওয়াত হোসাইন রাজীকে পাশের দেশে পাচার করে দেওয়া হয়েছে। এটা আমরা জানতাম না। হঠাৎ একদিন রাত ২টার দিকে জেল কর্তৃপক্ষ আমাকে খুঁজতে যায়। আমি আছি কি না জিজ্ঞাসা করে বাইরে প্রচারের বিষয়টি জানায়। শুধু মানসিকভাবে কষ্ট দিয়ে শেষ করে দেওয়ার জন্যই এই চেষ্টা করা হয়েছে।’
অসুস্থ সত্ত্বেও ডান্ডাবেড়ি পরানোর বিষয়ে মুফতি সাখাওয়াত বলেন, ‘বেড়ি পরাতে গিয়ে একদিন আমার এক পা রক্তাক্ত করে ফেলেছিল পুলিশ। ডানদিকের পায়ে এখনো সেই চিহ্ন আছে। আমি অনুরোধ করেছিলাম—ক্ষত পায়ে ডান্ডাবেড়ি থাকলে আমি তো অসুস্থ হয়ে যেতে পারি। তারা বলে, ওপরের নির্দেশ, ডান্ডাবেড়ি পরাতেই হবে। ডান্ডাবেড়ি তো অনেক দিনই পরিয়েছে; কিন্তু ওইদিন আমার বেশি কষ্ট হয়। লোহার একটি কড়া হাতুড়ি দিয়ে পেটাতে পেটাতে বন্ধ করার সময় একপাশ হয়ে আমার পায়ে ঢুকে যায়। এতে রক্তাক্ত হয়ে যায় পা। ওই রক্তাক্ত অবস্থায়ই আমাকে আদালতে নেওয়া হয়। সেখান থেকে হাজতে রাখার সময় হ্যান্ডকাফও পরানো হয়। ওইদিনই আমার বেশি কষ্ট হয়েছে।’
মুফতি সাখাওয়াতকে জঙ্গি-উগ্রবাদের তকমা দেওয়ারও চেষ্টা করেছে পুলিশ। এজন্য ডিবিতে এক সপ্তাহ যাবৎ তার রেকর্ডেড বক্তৃতা শুনেছে পুলিশ কোনো বক্তব্যের সূত্র ধরে তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রবিরোধী কোনো মামলা দেওয়া যায় কি না। কিন্তু রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ আনার মতো একটি শব্দও তারা খুঁজে পায়নি। এ প্রসঙ্গে মুফতি সাখাওয়াত বলেন, আমরা তো শান্তির জন্য কাজ করি। ইসলাম সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা বলে। বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। দেশে কোনো অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হোক—আলেম-ওলামারা কখনোই এটা করেননি। তবে একধরনের মিথ্যা অভিযোগ চাপানোর চেষ্টা করা হতো।
ওয়াজ-মাহফিল নিয়ে ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা জানান এই আলেম। তিনি বলেন, একটি মাহফিলের জন্য ৪০ বার অনুমতি নেওয়া লাগত। একপর্যায়ে আয়োজকরা কান্নাকাটি করতেন যে, কোনোভাবেই ওরা (প্রশাসন) অনুমতি দিচ্ছে না। উল্টো জঙ্গি-উগ্র বলে সরকারি লোকজন আয়োজকদের হুমকি দিত। অনেক সময় অনুমতি দেওয়ার পরও কাছাকাছি পৌঁছে শুনি প্যান্ডেল ভেঙে দিয়েছে, আমাকে আসতে নিষেধ করা হয়। নির্যাতিত এই আলেম বলেন, ‘ফ্যাসিবাদের বিচার হওয়া উচিত। প্রত্যেকটি জুলুমের বিচার হওয়া উচিত। তা না হলে এ দেশ স্থিতিশীল থাকবে না।’
সূত্র: আমার দেশ
No comments:
Post a Comment