Monday, January 20, 2025

মাওলানা নাছির উদ্দীন মুনির জেলখানায় মৃত্যুর মুখে লেখেন অসিয়তনামা। (BDC CRIME NEWS24)

BDC CRIME NEWS24

মাওলানা নাছির উদ্দীন মুনির জেলখানায় মৃত্যুর মুখে লেখেন অসিয়তনামা:

প্রকাশ : ২০ জানুয়ারি ২০২৫, ০৯: ২২

একজন আলেম ও অরাজনৈতিক ধর্মীয় সংগঠনের নেতার পাশাপাশি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ছিলেন মাওলানা নাছির উদ্দীন মুনির। চট্টগ্রামের হাটহাজারীর জনপ্রিয় এই ব্যক্তিকেও বিনা অপরাধে গ্রেপ্তার করে হাতকড়া পরানো হয়, রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতনের মাধ্যমে মিথ্যা স্বীকারোক্তি আদায় আর দীর্ঘ দুই বছর জেলে রেখে নির্মম অত্যাচার করেছে পতিত আওয়ামী সরকার।

নির্যাতনের একপর্যায়ে জেলে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখোমুখি অবস্থায় পরিবারের জন্য অসিয়তনামাও লিখেছিলেন তিনি। হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের এই যুগ্ম মহাসচিবের পরিবারও হয়রানি থেকে বাদ পড়েনি। জোর করে ভাড়া বাসা থেকে সরিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি দুই সন্তানের পাবলিক পরীক্ষা দিতে দেওয়া হয়নি। জেলে থাকায় বন্ধ ছিল ব্যবসা-বাণিজ্য। মুক্তির পর অনেকটা মানসিক ও শারীরিক নানা রোগে আক্রান্ত হয়েছেন হাটহাজারী উপজেলার সাবেক এই ভাইস চেয়ারম্যান।

নিজের করুণ অভিজ্ঞতা ছাড়াও দেশের আলেম-ওলামা নির্যাতনের বহু ঘটনার সাক্ষী মাওলানা মুনির। নিজের চোখে দেখেছেন শাপলা চত্বরের নির্মম হত্যাকাণ্ড। ২০১৩ সালের ৫ মের সেই ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ দমন-পীড়ন, দুঃশাসনের মাধ্যমে দেশ পরিচালনার কনসেপ্ট নিয়ে এগোয়।

তারই ধারাবাহিকতায় আলেম-ওলামাকে মূল প্রতিপক্ষ মনে করে শুরু করে নির্যাতন। সেদিন রাত ২টার পর শাপলা চত্বরে কীভাবে তারা জলকামান, সাউন্ড গ্রেনেড, ব্রাশফায়ার এবং সরাসরি গুলি করে হত্যা করেছে, তার প্রত্যক্ষ সাক্ষী তিনি। র‌্যাবের সাবেক ডিজি বেনজীর আহমেদকে সেদিন মঞ্চের পেছনে প্ল্যানিং করতে দেখেন এই আলেম।

শাপলা চত্বরের হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পরও আলেম-ওলামাদের নিয়ে নানা ধরনের ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ প্রসঙ্গে নাছির উদ্দীন মুনির বলেন, লালবাগ জোনের সাবেক ডিসি হারুন আল্লামা আহমদ শফিকে দিয়ে একটি বক্তব্য প্রচারে বাধ্য করেছিলেন। আল্লামা শফীসহ শীর্ষ কয়েকজন নেতাকে বিমানে দ্রুত ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। একইভাবে ফ্লাইট ধরতে লালবাগ থেকে এয়ারপোর্টের উদ্দেশে বের হলে পলাশী থেকে গ্রেপ্তার হন আল্লামা জুনাইদ বাবুনগরী। পরের দিন হেফাজত নেতাদের নামে দেওয়া হয় ৭০-৮০টি মামলা।

২০২১ সালে মোদিবিরোধী আন্দোলন ঘিরে হেফাজত নেতাকর্মী ও আলেম নির্যাতন করে আওয়ামী সরকার। বায়তুল মোকাররম, হাটহাজারী, ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ বিভিন্ন স্থানে গুলি করে আলেমদের হত্যা করা হয়। আর এসব ঘটনায় উল্টো শতাধিক মামলা হয় আলেম-ওলাদের বিরুদ্ধে।

মাওলানা মুনির জানান, হাটহাজারীতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে একটি অলিখিত চুক্তি হয় যে, কোনোপক্ষে কোনো মামলা হবে না। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে এক মাস পর হাটহাজারীতে ১২-১৪টা মামলা হয়। গ্রেপ্তার করা হয় শতাধিক আলেম ওলামাকে।

এ সময় গ্রেপ্তার এড়াতে হাটহাজারী মাদরাসায় প্রায় দুই মাস অবরুদ্ধ ছিলেন শীর্ষ আলেমরা। তাদের বের করে দিতে জুনায়েদ বাবুনগরীকে চাপ দিলেও তিনি অস্বীকৃতি জানান। একপর্যায়ে রমজান মাসে সেখানে পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবির প্রায় দুই হাজার ফোর্স ঘেরাও করে। এ সময় তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বাবুনগরীকে হেফাজতের কমিটি স্থগিত করতে বলেন।

একপর্যায়ে বাধ্য হয়ে ওই কমিটি স্থগিত করে সরকারি প্রেসক্রিপশনে নতুন অস্থায়ী কমিটি ঘোষণা করা হয়। দুই মাস পর স্থানীয় এমপি তাদের গ্রেপ্তার না করার আশ্বাসে স্বাভাবিক চলাফেরার পরামর্শ দেন। কিন্তু বাস্তবে সেদিন একটি কাজে শহরে বের হওয়ার পরই ডিবির হাতে আটক হন মাওলানা মুনির।

প্রতারণার ফাঁদ পেতে একজন জনপ্রতিনিধি ও আলেমকে গ্রেপ্তারের বর্ণনা দিয়ে নাছির উদ্দীন মুনির বলেন, সেদিন ছিল ২০২১ সালের ২০ জুন। তাকে গ্রেপ্তার করে মামলা দিয়ে আদালতের মাধ্যমে জেলে পাঠানো হয়। চট্টগ্রাম কারাগারের কনডেম সেলে ঢোকানো হয় তাকে।

সেখানে মানবেতর জীবন কাটাতে হয়েছে। প্রায় ছয় মাস। ২৪ ঘণ্টা লকআপে ছিলেন। সেই কষ্ট জানানোর ভাষা নেই। শুধু দিনে ২০ মিনিটের জন্য খোলা হলে বালতিতে ব্যবহারের পানি আনতেন আর গোসল করতেন। এক মিনিট দেরি হলেই কারারক্ষীরা চিল্লাতেন।

এ সময় পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিয়ে ডিবি অফিসে নতুন করে নির্যাতন চলে এই আলেমের ওপর। ডিবিতে ছোট একটি রুমে ছিল না কোনো কম্বল-বালিশ। ফ্লোরেই কাটাতে হয়েছে চার দিন। দুই হাতে লকআপ অবস্থায় বসে ঘুমাতে হতো। রাত ২টায় এসে ঘুম থেকে তুলে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। ঘুমাতে চাইলে বলা হয়, আপনি ঘুমাতে পারবেন না। এভাবে সেখানে ১৬৪ ধারায় অনেক ধরনের মিথ্যা স্বীকারোক্তি নেওয়া হয়। তাদের লিখে দেওয়া বিষয়গুলো মুখস্থ করে আদালতে বলতে হয়।

মুনির বলেন, সেখানে ডিবির তৎকালীন ওসি কেশব ভট্টাচার্য্য তার পেছনে হাতকড়া পরা অবস্থায় দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। তিনি কষ্টের কারণে বসতে চাইলে ওসি বলেন, আসামি কখনো বসতে পারে? বেশি কথা বললে লটকায়ে ফেলব। আপনার নেতৃত্বেই হাটহাজারীর সব ঘটনা ঘটেছে। নির্যাতন সইতে না পেরে এবং আবার রিমান্ডে নেওয়ার হুমকি দেওয়ায় তার লিখে দেওয়া বিষয়গুলো মুখস্থ করে পরদিন কোর্টে বলেন তিনি। ম্যাজিস্ট্রেটের পরামর্শ নিলে তিনিও একই কথা বলেন।

এক মাসের মাথায় দ্বিতীয় দফায় পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয় মাওলানা মুনিরকে। পিবিআইয়ের সেই রিমান্ডেও একইভাবে জিজ্ঞাসাবাদ এবং স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়। রিমান্ড শেষে আবার জেলে পাঠানো হয় তাকে। এভাবে ১৪টি মামলায় দীর্ঘ দুই বছর জেলে কাটিয়ে ২০২৩ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি জামিনে মুক্তি পান তিনি।

মাওলানা মুনির বলেন, গ্রেপ্তারের পর প্রথম এক বছর হেফাজত নেতাকর্মীদের জামিন দেওয়া হয়নি। এক বছর পর অন্যদের জামিন দেওয়া শুরু হলেও তার জামিন আটকে রাখা হয়। আদালতকে বলে দেওয়া হয়েছিল, আমি সবচেয়ে বড় নেতা, সবকিছু আমার নির্দেশেই ঘটেছে। এ জন্য আমাকে জামিন দেওয়া যাবে না। তাই বারবার জামিন আবেদন করলেও তা নাকচ করে দেয় আদালত।

তিনি বলেন, জেলে সাধারণ কয়েদিদের যে ধরনের সুযোগ-সুবিধা আছে, তা হেফাজত নেতাকর্মী হিসেবে আমরা পেতাম না। প্রথম ছয় মাস পুরো সময় কনডেম সেলে বন্দি এবং পরের ছয় মাস আধা ঘণ্টার জন্য খুলে দেওয়া হতো। এক দিন কোর্টে নেওয়ার সময় আমাকে হ্যান্ডকাফ ছাড়াও ডান্ডাবেড়ি পরানোর জন্য চাপাচাপি করে পুলিশ। আমি প্রতিবাদ করেও ঠেকাতে পারিনি।

শুধু তাই নয়, জেলজীবনে চরম নির্যাতনের একপর্যায়ে মৃত্যুর শঙ্কা থেকে একজনের মাধ্যমে কিছু কাগজ জোগাড় করে ১৬ পৃষ্ঠায় একটা খাতা বানিয়ে তাতে বিস্তারিত অসিয়তনামা লিখি। সেটি রুমমেটকে আমার লাশের সঙ্গে বিছানার মধ্য দিয়ে দিতে বলি।

মাওলানা মুনিরের ১৪টি মামলার মধ্যে ১২টিই ছিল ২০২১ সালে হাটহাজারীতে জ্বালাও, পোড়াও ইত্যাদি অভিযোগের। আর দুটি ছিল ২০১৩ সালে শাপলা চত্বরের হত্যাকাণ্ডের। দুই বছর জেলে ও রিমান্ডে কাটানো শেষে মুক্তির পরও মানসিক রোগী হয়ে গিয়েছিলেন তিনি।

এদিকে মুক্তির পর অনেক অনুরোধ করে এনএসআই হেডকোয়ার্টারে ডেকেছিলেন তাকে। সেখানে তার গ্রেপ্তার-জেলের জন্য দুঃখ প্রকাশ করে সরকারের জন্য বিব্রতকর কোনো কাজ না করার অনুরোধ জানানো হয়। এ ছাড়া ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের সময় তাকে প্রার্থী হওয়ার প্রলোভন দেওয়া হয়। তবে মানসিকভাবে একটু সুস্থ হওয়ার পর এসব প্রত্যাখ্যান করে এবং হুমকি উপেক্ষা করেই তিনি তার কর্মকাণ্ড ও তৎপরতা অব্যাহত রাখেন।

তিনি বলেন, গ্রেপ্তারের আগে শুধু প্রেশার ছাড়া আমার কোনো রোগ ছিল না। কিন্তু জেল থেকে বের হওয়ার পর হার্ট ও প্রোস্টেটে সমস্যা, কোলেস্টেরল বাড়াসহ বিভিন্ন রোগ সৃষ্টি হয়। এসবের চিকিৎসা চলছে। এ ছাড়া ১৪টি মামলায় নিয়মিত হাজিরা দিতে গিয়ে হয়রানির শিকার হতে হয়েছে। মামলাগুলো এখন থাকলেও সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী তা অব্যাহতির প্রক্রিয়া চলছে।

মাওলানা মুনির বলেন, গ্রেপ্তারের আগেই মাদরাসায় অবরুদ্ধ অবস্থায় হঠাৎ এক দিন দুই ঘণ্টা সময় নিজের ভাড়া বাসা ছাড়তে বাধ্য করে পুলিশ। এতে মালপত্র বাড়িতে পাঠিয়ে দুই বছর এলোমেলো ও বিপন্ন অবস্থায় আমার পরিবার জীবনযাপন করেছে।

একইভাবে দুদিনের মধ্যে অফিসও খালি করতে বলা হয়। পরে বন্ধুরা বিভিন্ন মহলে যোগাযোগ করে অর্ধেক জায়গায় অফিসটি রাখার ব্যবস্থা করে। তিনি বলেন, জেলে থাকা অবস্থায় আমার বড় মেয়েকে এইচএসসি পরীক্ষা দিতে দেয়নি। ছোট মেয়েটাও দাখিল পরীক্ষা দিতে পারেনি। আমার মুক্তির পর এক বছর লস দিয়ে তাদের পরীক্ষা দিতে হয়েছে।

ব্যবসা-বাণিজ্যে ক্ষতির মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু হয়ে গিয়েছেন বলে জানান মাওলানা মুনির। তিনি বলেন, এখন নতুন করে ব্যবসাগুলো শুরু করতে হচ্ছে। যারা এভাবে আলেম-ওলামাসহ সাধারণ মানুষের ওপর জুলুম-নিপীড়ন চালিয়েছে, যারা দেশকে এই পরিস্থিতির মুখে এনেছে, সেই ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ও তার দোসরদের বিচার দাবি করেন তিনি।

সূত্র: আমার দেশ 

No comments:

Post a Comment

এনএসআইয়ে ‘র’ নেটওয়ার্ক। (BDC CRIME NEWS24)

BDC CRIME NEWS24 এনএসআইয়ে ‘র’ নেটওয়ার্ক: প্রকাশ : ১৯ আগস্ট ২০২৫, ০৮: ২৭ বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআইয়ের অভ্যন্তরে ২০০৯ ...