Tuesday, January 28, 2025

আলেম নির্যাতন- কারেন্টের শক দেওয়া হয় ঘাড়ে ও গোপনাঙ্গে। (BDC CRIME NEWS24)

BDC CRIME NEWS24

আলেম নির্যাতন-

কারেন্টের শক দেওয়া হয় ঘাড়ে ও গোপনাঙ্গে:

প্রকাশ : ২৮ জানুয়ারি ২০২৫, ০৮: ৫০

হাটহাজারী মাদরাসা এলাকায় বেশ পরিচিত মুখ মাওলানা আমিনুল ইসলাম। ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি হেফাজতে ইসলামের ব্যানারে বিভিন্ন কর্মসূচিতে সক্রিয় থাকতেন তিনি।

সংগঠনটির হাটহাজারী পৌরসভা কমিটির সহকারী দাওয়াহ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। শীর্ষ আলেমদের সঙ্গে ওঠাবসার কারণে বিগত ফ্যাসিবাদী সরকারের টার্গেটে পড়েন তিনিও। বিনা অপরাধে তাকে গ্রেপ্তার করে হেফাজতের সুইসাইড স্কোয়াডের সদস্য হিসেবে উপস্থাপন করা হয়।

মিথ্যা স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য ১৯ দিন রিমান্ডে নিয়ে চালানো হয় বর্বর নির্যাতন। চট্টগ্রামের তৎকালীন এসপি রশিদুল ও ডিবির ইন্সপেক্টর কেশব চক্রবর্তীর নেতৃত্বে তাকে উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখা, নখ উপড়ে ফেলা এবং কারেন্টের শক দেওয়া হয়।

এমনকি তাকে ক্রসফায়ারে দেওয়ার পরিকল্পনাও করা হয়েছিল। রিমান্ডে অব্যাহত নির্যাতনে গুরুতর আহত হয়েও দীর্ঘ ২৩ মাস বিনা চিকিৎসায় জেলে চরম দুর্ভোগে কাটে তার সময়। মুক্তির পর নানা শারীরিক সমস্যায় এখনো স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি তরুণ এই আলেম।

মাওলানা আমিনুল ইসলাম জানান, ২০২১ সালে নরেন্দ্র মোদিবিরোধী আন্দোলন ঘিরে চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদরাসা এলাকায় শুরু হয় আলেম-ওলামা নির্যাতের মহোৎসব। এ পরিস্থিতিতে গ্রেপ্তার এড়াতে হাটহাজারী ছেড়ে ফটিকছড়িতে নানাবাড়িতে আশ্রয় নেন তিনি, কিন্তু সেখানেও গ্রেপ্তার হতে হয় তাকে।

২৫ মার্চ মধ্যরাতে ফটিকছড়ির লেলাংয়ের রায়পুর গ্রামের সেই বাড়িতে হানা দেয় র‌্যাব, ডিবি ও সোয়াত টিমের ২৭টি গাড়ি। ওই বাড়িতে ঢুকেই নারী-পুরুষ সবাইকে জিম্মি ও হেনস্তা করে গ্রেপ্তার করা হয় আমিনুলকে। একই সঙ্গে তিন দিন আগে বিবাহিত তার এক মামাতো ভাইকেও নিয়ে যায় তারা। বাড়িতে অস্ত্র-গুলির সন্ধানও জানতে চায় তারা।

হেলমেট পরিয়ে ও পেছনে হ্যান্ডকাফ লাগিয়ে হেফাজতের ‘সুইসাইড স্কোয়াড’-এর সদস্য আখ্যা দিয়ে কড়া নিরাপত্তায় অনেক পথ ঘুরিয়ে আমিনুলকে নেওয়া হয় চট্টগ্রাম এসপি কার্যালয়ে। সেখানে এসপি এসএম রশিদুল হক তাকে প্রশ্ন অনুযায়ী জবাব দিতে বলেন। সেক্ষেত্রে ছেড়ে দেওয়ারও আশ্বাস দেওয়া হয় তাকে। বলা হয়, ‘তুমি বাবুনগরীর নির্দেশে পুলিশকে মেরেছ, ভূমি অফিসে আগুন দিয়েছ—এসব স্বীকার কর?’ এসবে জড়িত নয় জানালে তাকে কিছুক্ষণ পর নেওয়া হয় পাঁচলাইশ থানায়।

সেখানেও একই বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়। জবাবে সন্তুষ্ট না হওয়ায় মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করার হুমকি দেয় তারা। পরে তাকে কালোক্যাপ ও হ্যান্ডকাফ পরিয়ে পাশের রুমে নিয়ে কয়েজকন মিলে এলোপাতাড়ি মারতে থাকে। এতে তার নাক-মুখ দিয়ে রক্ত বের হতে থাকে। কিছুক্ষণ পর তারা রক্ত মুছে দিয়ে দুজন ধরে আরেকটি রুমে নিয়ে বসায়। এ সময় পানি চাইলেও দেয়নি তারা। এভাবে সকাল পর্যন্ত সেখানে বসিয়ে রাখা হয়। সকালেও পানি চাইলে ময়লা-আবর্জনা দিতে বলে একজনকে।

সকাল ৯টায় আদালতের ওয়েটিং রুমে নিয়ে বসিয়ে মিথ্যা স্বীকারোক্তি দেওয়ার প্র্যাকটিস করানো হয়। স্বীকারোক্তি দিলে ছেড়ে দেওয়ার আশ্বাস দেয় তারা। সে সময় মাথাঘুরে বেহুঁশ হয়ে যান আমিনুল। হুঁশ ফেরাতেও ব্যাপক নির্যাতন করে পুলিশ। অনেক চেষ্টার পরও হুঁশ ফেরাতে না পেরে ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে পরামর্শ করে তাকে মেডিকেলে নিয়ে যায়।

অবস্থা খারাপ দেখে ডাক্তার তাকে বেডে নিতে বলেন। কিন্তু পুলিশ তাতে রাজি না হয়ে তাৎক্ষণিকভাবে কিছুটা সুস্থ করার পরামর্শ দেয়। সেখানে ডিবির ইনস্পেক্টর কেশব চক্রবর্তী গিয়ে দ্রুত চিকিৎসা দিতে বলেন। এরপর একটি ইনজেকশন দিলে তার ব্যথা কমে। আবার তাকে নেওয়া হয় এসপি কার্যালয়ে। সেখানে দুপুর ১২টায় তিনজন এসে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করেন এবং এরপর তাকে নেওয়া হয় কোর্টে। পরে একবার পাঁচলাইশ থানায়, আরেকবার এসপি কার্যালয়ে, সর্বশেষ পাঁচলাইশ থানায় নিয়ে তাকে বিস্ফোরক মামলায় জড়িয়ে ফের কোর্টের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়।

রাত ৯টায় কারাগারে নিয়ে মাওলানা আমিনুল ইসলামকে খুব সাবধানে রাখার জন্য কারা কর্তৃপক্ষকে পরামর্শ দেয় পুলিশ। সে অনুযায়ী তাকে কনডেম সেলে (কবর সেল হিসেবে পরিচিত) ২৪ ঘণ্টা লকাপে রাখা হয়। তার দুপাশের সেলে জামায়াত নেতা শাহজাহান চৌধুরী ও হেফাজত নেতা আজিজুল হক ইসলামাবাদী ছিলেন।

সকালে তাকে কারা মেডিকেলে নিয়ে চেকাপ করে নিয়ে আসে। সেখানে সন্ত্রাসী ও জঙ্গি হিসেবে তার পরিচয় ছড়িয়ে দেওয়া হয়। করোনার কারণে সে সময় ভার্চুয়াল কোর্টে উপস্থাপন করা হলে মহিলা জজ তাকে দ্রুত সুস্থ করার নির্দেশ দেন। এতে কারা মেডিকেলের ডা. শামীম রেজা তাকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করে বলেন, ‘তুই মরোছ না কেন?’

আট দিন পর কিছুটা সুস্থ হলে তাকে ভার্চুয়াল কোর্টে তোলা হয়। তাকে দেখে ঠিক আছে বলে আগের ১০ দিনের রিমান্ড ক্যানসেল করে ১২ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়। পরে তাকে শীর্ষ সন্ত্রাসীর মতো ১২টি গাড়ির স্কোয়াড দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় চট্টগ্রাম জজকোর্টে।

সেখানে পুলিশ ছাড়া আর কেউ ছিল না। মহিলা জজের সামনে উপস্থাপন করলে তিনি রিমান্ডে নেওয়ার মতো ফিট আছে বলে জানান। পরে তাকে এসপি কার্যালয়ে নেওয়া হয়। সেখানে একটি রুমে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয়। মিথ্যা স্বীকারোক্তি নিতে নানাভাবে ব্ল্যাকমেইলের চেষ্টা করা হয়। এসময় গাড়ি, বাড়ি, নারী—সবকিছু দেওয়ার প্রলোভন দেওয়া হয় তাকে।

নগদ ১০ লাখ টাকা দেখিয়ে বাসায় পৌঁছে দেওয়ার কথা বলা হয়। তার কাছে জানতে চাওয়া হয়—পাকিস্তান থেকে কত টাকা কার কাছে এসেছে, আইএসআইয়ের সঙ্গে তোমাদের কী সম্পর্ক, হাটহাজারী মাদরাসার আয়ের উৎস কী প্রভৃতি। এভাবে দুদিন ধরে কোনো স্বীকারোক্তি না নিতে পেরে নির্যাতনের হুমকি দেয় পুলিশ। একপর্যায়ে এসপি রশিদুল টেবিল থাপড়িয়ে উপস্থিত ডিবির ইন্সপেক্টর কেশব চক্রবর্তী, এসআই হান্নান ও পারভেজকে নির্যাতনের নির্দেশ দেন।

তখন তাকে পাশে টর্চার সেলে নিয়ে যায়। সেখানে নিয়ে শুরু হয় মারধর। মরার মতো অবস্থা হয়ে যায়। পরে তাকে ঝোলানো হয়। হাত-পায়ের তালুতে মারা হয়। এসময় তিনি পানি চাইলে কেশব চক্রবর্তী প্রস্রাব করে দেওয়ার কথা বলে। এভাবে সারাক্ষণ দাঁড় করিয়ে রাখা হয় তাকে। দাঁড়াতে না পারলে পাশে জানালার গ্রিলের সঙ্গে হ্যান্ডকাফ বাঁধিয়ে ঝুলিয়ে রাখা হয়।

রিমান্ডের সময় খাবার হিসেবে তিন বেলা দেওয়া হতো একটা পরোটা ও এক বোতল পানি। এ সময় তারা সহজে প্রস্রাব-পায়খানা করতে দিত না। গোসল করতে দেয়নি। নামাজের সময় দিত ৫ মিনিটের মতো। বেশি সময় লাগলে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিত। এভাবে দীর্ঘ ১২ দিনের রিমান্ডেও কোনো স্বীকারোক্তি না পেয়ে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয় মাওলানা আমিনুলকে। এরই মধ্যে হাটহাজারী, পটিয়া ও পাঁচলাইশ থানায় একে একে ১৪টি মামলা করা হয় তার বিরুদ্ধে।

মাত্র ছয় দিন পর আবার ছয় দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে আদালত। তাকে নেওয়া হয় এসপি কার্যালয়ে। সেখানে তাকে প্রতি কথায় ধাপ্পড় আর দাড়ি ধরে টেনে ছিঁড়ে ফেলেন ডিবির ইনস্পেক্টর কেশব চক্রবর্তী। একপর্যায়ে রাতে তাকে মুখে কালো কাপড় পরিয়ে কালো গাড়িতে তুলে বাইরে নিয়ে যায় পুলিশ। এসময় তাকে বিভিন্ন পথে ঘোরায় আর ক্রসফায়ারে দেওয়ার কথা বলে।

সুবিধাজনক জায়গা খুঁজছিল তারা। গাড়ি থেকে লাথি মেরে ফেলে দিয়ে মিথ্যা স্বীকারোক্তি দিতে বলে। নইলে মেরে ফেলে রাখার হুমকি দেওয়া হয়। এসময় তিনি মৃত্যু অনিবার্য জেনে কালেমা পড়ছিলেন, আর মা-বাবার কথা স্মরণ করছিলেন। কিছুক্ষণ পর তাকে আবার গাড়িতে তোলা হয়। আনুমানিক আধা ঘণ্টা গাড়ি চলার পর ডিবি কার্যালয়ে আনা হয়।

এসপি কার্যালয়ে অবস্থিত ডিবির সেই টর্চার রুমে আবার তাকে নিয়ে পেটানো শুরু হয়। এ সময় কোনো ঘুমের সুযোগ ছিল না। বাথরুম করতে হতো তাদের ইচ্ছামতো। একপর্যায়ে তার কোমরে একটা ইনজেকশন দেওয়া হয়। এভাবে রিমান্ডে চার দিন নির্যাতন চালিয়েও কোনো স্বীকারোক্তি না পেয়ে প্লায়ার্স থেরাপি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় তারা।

আরেকজনের পরামর্শে প্লায়ার্স থেরাপির আগে কারেন্টের শক দেওয়া হয় ঘাড়ে ও গোপনাঙ্গে। এরপরও কোনো স্বীকারোক্তি দেননি তিনি। পরে রাত ১২টায় তার হাত-পা বেঁধে একের পর এক হাতের সব নখ প্লায়ার্স দিয়ে উপড়ে ফেলা হয়। এ অবস্থায় বেহুঁশ হয়ে যান তিনি। হুঁশ ফিরলে দেখেন তার গায়ে ঘাম, আর রক্ত নিচে পড়ে ভিজে যাচ্ছে। তবে ব্যথানাশক কিছু দেওয়ায় ব্যথা লাগছিল না।

পরের দিন তাকে কোর্টে তুলে সাদা কাগজে স্বাক্ষর নেওয়ার চেষ্টা করা হয়। হাত দিয়ে স্বাক্ষর দিতে না পারায় তারাই ভুয়া স্বাক্ষর দিয়ে কোর্টে জমা দেয়। এ সময় মহিলা জজও তাকে স্বাক্ষর ও মিথ্যা স্বীকারোক্তি দিতে চাপ দেন। পরে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। টানা আট মাস ২৪ ঘণ্টা লকাপে রাখা হয় তাকে।

এসময় হাত-পায়ে প্রচণ্ড ব্যথা আর পুঁজ পড়া শুরু হয়। ব্যথায় সারা দিনরাত চিৎকার করতেন তিনি। এজন্য পাশের বন্দিরাও কারারক্ষীদের কাছে প্রতিবাদ করতেন। তারপরও কোনো চিকিৎসা দেওয়া হতো না তাকে। শুধু ব্যথার ইনজেকশন দেওয়া হতো।

দীর্ঘ আট মাস পর জাতিসংঘের একটি পরিদর্শন টিম এসে তার এই নির্যাতনের অবস্থা দেখে তাকে কারা মেডিকেলে রাখার পরামর্শ দেয়। পরে আরও একটি টিম এসে একই পরামর্শ দেয়। সে অনুযায়ী তাকে মেডিকেলে বেডে দেওয়া হয়। সেখানে পাঁচ-ছয় দিন নামমাত্র চিকিৎসা শেষে আবার কনডেম সেলে ঢোকানো হয়। সেখানেই ২৩ মাস কাটে তার। একপর্যায়ে সব মামলায় জামিন নিয়ে মুক্তি পান তিনি।

মাওলানা আমিনুল ইসলাম জানান, মুক্তির পরও তিনি প্রচণ্ড অসুস্থ ছিলেন। আর্থিক সংকটের কারণে ভালো চিকিৎসা করা সম্ভব হয়নি। এখনো তার নখগুলোতে ব্যথা। চোখে কম দেখেন। ব্রেনেও সমস্যা হয়েছে। নাক দিয়ে রক্ত বের হয়। কোনো কাজকর্ম ঠিকমতো করতে পারেন না তিনি।

সূত্র: আমার দেশ 

No comments:

Post a Comment

ধর্ষণ থামছে না, ফেব্রুয়ারিতে দিনে গড়ে ১২টি মামলা। (BDC CRIME NEWS24)

BDC CRIME NEWS24 ধর্ষণ থামছে না, ফেব্রুয়ারিতে দিনে গড়ে ১২টি মামলা: (নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলা: ২০২৪: জানুয়ারি–জুলাই ১০,৭০৪টি, ২০২৪: আগস্ট...