Sunday, January 12, 2025

মুফতি মোহাম্মদ জসীমউদ্দিন রাহমানীকে জঙ্গি বানাতে ১১ বছর বর্বর নির্যাতন। (BDC CRIME NEWS24)

BDC CRIME NEWS24

মুফতি মোহাম্মদ জসীমউদ্দিন রাহমানীকে জঙ্গি বানাতে ১১ বছর বর্বর নির্যাতন:

প্রকাশ : ১১ জানুয়ারি ২০২৫, ১০: ৩৪

আওয়ামী সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্মম নির্যাতনে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছেন মুফতি মোহাম্মদ জসীমউদ্দিন রাহমানী। ২০১৩ সালে ঈদ মৌসুমে নিজের বাড়ি থেকে ৩২ জন আত্মীয়স্বজনসহ গ্রেপ্তার হন তিনি। এরপর আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নামের জঙ্গি সংগঠনের নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে একের পর এক মামলা দিয়ে দীর্ঘ আড়াই মাস রিমান্ডসহ নানাভাবে বর্বর নির্যাতন চালায় র‌্যাব, ডিবি ও সিটিটিসি বাহিনী।

বিনা অপরাধে ১১ বছর জেল খাটেন তিনি। একই নাটক প্রমাণ করতে তার ছোট ভাইকেও গ্রেপ্তার-নির্যাতনের একপর্যায়ে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। এভাবে দীর্ঘ ১১ বছর ১৬ দিন জেলের অন্ধকারে কাটিয়ে গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী পরিস্থিতিতে গত বছরের ২৬ আগস্ট মুক্তি পান তিনি। কিন্তু এখনও নির্যাতনের সেই কষ্টে হাঁটাচলাসহ স্বাভাবিকভাবে জীবনযাপন করতে পারছেন না।

দেশের অন্যতম ইসলামি চিন্তাবিদ, খতিব, ইমাম এবং বক্তা মুফতি মোহাম্মদ জসীমউদ্দিন রাহমানী। বরগুনা সদর উপজেলার হেউলিবুনিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করা রাহমানী লেখাপড়া করেছেন দেশি-বিদেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। দেশের বিভিন্ন মাদরাসায় শায়খুল হাদিস ও মুহাদ্দিস হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

একপর্যায়ে নিজেই ধানমন্ডির বসিলা রোডে মারকাজুল উলুম আল ইসলামিয়া নামে একটি মাদরাসা ও মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানেই দায়িত্ব পালন করতেন তিনি। একপর্যায়ে আওয়ামী সরকারের রোষানলে পড়েন এই আলেম। মূলত, আওয়ামী সরকার এবং শেখ হাসিনার ইসলামবিরোধী বিভিন্ন কর্মকাণ্ড এবং বক্তব্যের প্রতিবাদ করার কারণেই তাদের টার্গেটে পড়েন তিনি।

আমার দেশকে সেসব নির্যাতনের বর্ণনা তুলে ধরে তিনি বলেন, ২০১৩ সালে রোজার ঈদের নামাজ ঢাকায় পড়িয়ে বাড়িতে যান তিনি। বরগুনার হেউলিবুনিয়া গ্রামের সেই বাড়িতে তার ভাই-তাতিজাসহ আত্মীয়স্বজন সবাই মিলিত হন। সকাল ১০টার দিকে কয়েকজন লোক সেখানে গিয়ে বলে যে, আমরা নাকি পরের দিন হরতালে নাশকতার পরিকল্পনা করছি বলে তাদের কাছে তথ্য আছে। আমরা অবাক হয়ে যাই। একপর্যায়ে ছোট ছোট বাচ্চাসহ ৩৩ জনকে সেখান থেকে বরগুনা থানায় নিয়ে যায় তারা। পরে চরমোনাই পীরের একজন মুরিদকে সংশ্লিষ্টরা ছাড়িয়ে নেন। আমাদের ৩২ জনের বিরুদ্ধে ৫৭ ধারায় মামলা দেওয়া হয়। সঙ্গে ৯২ ধারাও লাগায়। এ সময় পাঁচ থানার পুলিশ এসে বাসা ঘিরে রাখে।

তিনি বলেন, তাদের এই গ্রেপ্তারের পেছনে একজন পীরের মুরিদদের হাত থাকতে পারে। কারণ ওই পীরের সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব ছিল। স্থানীয় সাংবাদিক মোশাররফ ও এসবির আবদুস সাত্তার মিলে এই নাটকে সহযোগিতা করেন। বিভিন্ন মিডিয়ায় লাইভ প্রচার করা হয়, বরগুনায় জলিল মাস্টারের বাড়ি থেকে (বড় ভাই) মুফতি মোহাম্মদ জসীমউদ্দিন রাহমানীসহ ৩২ জঙ্গি গ্রেপ্তার। তখন বুঝতে পারলাম, সাজানো একটা নাটকের মধ্যে পড়ে গেছি।

বরগুনা থানার মামলায় আদালত চার দিন রিমান্ড মঞ্জুর করলেও মুফতি মোহাম্মদ জসীমউদ্দিন রাহমানীকে নেওয়া হয় ঢাকার ডিবিতে। সেখানে কালো কাপড় দিয়ে তার চোখ বেঁধে ফেলা হয়। পরে নেওয়া হয় উত্তরার র‌্যাব কার্যালয়েও। খাওয়া-ঘুম নেইÑ এমন অবস্থায় রাত ৩টার দিকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয়। তিনি কোন দল করেন, কী করেন জানতে চান।

তিনি বলেন, প্রথমে তাকে জামায়াতের নেতা বানানোর চক্রান্ত করা হয়। তখন তিনি বলেন, জামায়াত তো ক্যাডারভিত্তিক একটি সংগঠন। সেখানে যে কেউ ইচ্ছা করলেই নেতা হতে পারেন না। জামায়াত করলে প্রমাণ দেখান। তারা বুঝল যে, জামায়াত বানানো যাবে না। তখন প্ল্যান-প্রোগ্রাম করে ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম’ নামে নতুন একটি দল করল (পরে জানতে পেরেছি)। আমি আদালতেও লিখিতভাবে চ্যালেঞ্জ করেছিলাম, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নামে বাংলাদেশে কোনো দল নেই। আমার অজান্তে যদি থেকে থাকে, তাহলে তার সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। তখন ব্লগার রাজিব হায়দার হত্যা মামলায় জড়াল।

প্রচার করল যে, আমি প্রধান আসামি। এরপর আসিফ মহিউদ্দিন নামে আরেক ব্লগারকে কোপানোর মামলায়ও জড়ানো হলো। এভাবে পাঁচটি মামলা তৈরি করা হলো। একেক মামলায় ১৪/১৫ দিন করে রিমান্ডে নেওয়া হয়। দুই ধাপে সাত দিন, ১০ দিন করে প্রায় দুই মাস রিমান্ডের বন্দোবস্ত করা হয়। রিমান্ডে রাত-দিন ঘুমাতে দেওয়া হয়নি।

জিজ্ঞাসাবাদ কিছুই না, শুধু গল্প করে। তারা তো সব জানে। তারা উপহাস করত। আমরা তো সব জানি আপনি কোনো দল করেন না। কিন্তু আমরা একটা চারা লাগিয়েছি, বিজ বপন করেছি। আমরা আপনাকে অনেক বড় বানাব। তারা আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নামে একটা শিট তৈরি করে। তারা এ বিষয়ে আমার মুখ দিয়ে স্বীকার করাতে চেয়েছিল। আমি বলি যে, এগুলো সাংগঠনিক পরিভাষা। আমি এ সংগঠন করি না আমার জানাও নেই।

তিনি বলেন, আমার মনে হয়েছে, তাদের পেছনে মৌলভিদের একটা দলও সহযোগিতায় ছিল। যারা আমার গ্রেপ্তারের পেছনেও জড়িত ছিল। এসব খবর আবার পত্রিকায় প্রকাশ করে আমাকে দেখাত যে, আপনি একটা বড় দলের লিডার হয়ে গেছেন। আপনি আধ্যাত্মিক নেতা। আমি বুঝলামÑএটার প্রতিষ্ঠাতা ছিল ডিবির মশিউর রহমান। পরে সাইফুল ইসলাম নামে আরেকজন বদলি হয়ে আসেন ডিবিতে। তিনি আমাকে বিভিন্ন বিষয়ে জিজ্ঞাসা করেন। একপর্যায়ে মেজর জিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ততার চেষ্টা করেন। আমি বলেছিলামÑ তার নামও আমি জানি না। তাকে আমার ছাত্র হিসেবে পরিচয় করানোর চেষ্টা করে। এভাবে বড় চক্রান্ত ছিলÑ যদিও তার প্রমাণ করতে না পারায় বেশি এগোতে পারেনি।

এভাবে মামলার সংখ্যা বাড়তে থাকে মুফতি মোহাম্মদ জসীমউদ্দিন রাহমানীর। একই সঙ্গে বাড়ে রিমান্ডের সংখ্যাও। আমি আদালতে বলেছিলাম, আমার কোনো বক্তব্য, কোনো বইয়ে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের কোনো নাম কোথাও আছে কি না খুঁজে দেখার ব্যবস্থা করেন।

কেউ দল করলে, তিনি তার বক্তব্যে-লেখায় আহ্বান জানাবেনÑএটাই স্বাভাবিক। আমাকে যদি বাংলা টিমের সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ করতে পারেন, তাহলে জেলে রাখার দরকার নেই, আদালতের সামনে ক্রেন এনে তার মাথায় ফাঁসি দিয়ে ঝুলিয়ে রাখুন। সবাই দেখুক। আর প্রমাণ না করতে পারলে কী করবেন আপনি ভালো জানেন।

রাজিব হত্যা মামলার বিচার চলতে চলতে ২০১৫ সালে এটার রায় হয়। এ রায়ের পর্যবেক্ষণে লেখেন, এ মামলার আসামিরাÑ এমনকি জসীমউদ্দিন রাহমানী, যাকে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান হিসেবে প্রচার করা হয়েছে, মূলত, রাষ্ট্রপক্ষ হয়তো তদন্ত করেনি অথবা প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। মূলত প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছে। তারপরও ওই হত্যায় উসকানির বিবেচনায় পাঁচ বছর সাজা দেওয়া হয়। এতে প্রমাণ করে যে, ওই মামলার সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক ছিল না। এ রায়ের পর বাকি কোনো মামলার বিচার আজ পর্যন্ত শুরু হয়নি।

এরপর ব্লগার আসিফ মহিউদ্দিন হত্যার নাটক সাজিয়ে মিথ্যা মামলায় আমাকে জড়ানো হয়। এভাবে ভুয়া মামলা দিয়ে আসামি বানানো হয়। মোহাম্মদপুর থানায় দুটি মামলা দেওয়া হয়। সেখানে একটি দোকানে অভিযানের নামে নাটক সাজিয়ে আমাকে সেখান থেকে গ্রেপ্তারের মিথ্যা নাটক সাজানো। দোকানের মালিক সাইফুল্লাহ নামে আরেকজন পলাতক বলে জানায় ডিবি। অথচ পরে সেই ব্যক্তিকে ডিবিতে দেখা যায়। তাকে আসামি বা সাক্ষী কিছুই বানানো হয়নি। আসলে সে তাদেরই লোক। সম্ভবত ধানমন্ডির সেই যুবলীগ নেতার পরিচিত।

তাদের উদ্দেশ্য ছিল আমাকে আটকে রাখা। পুরোনো মামলায় জামিনের সম্ভাবনা থাকায় রাজিব হত্যা মামলা শেষ হওয়ার দিন পুলিশ গিয়ে নতুন আরেকটি মামলা দেয়। ‘লেকহেড গ্রামার স্কুলে’ মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্ব ছিল। এটাকে ভিন্নদিকে নিতে সাজায় যে, এই স্কুলের মাধ্যমে জঙ্গিবাদ ঢোকানোয় জড়িত মুফতি মোহাম্মদ জসীমউদ্দিন রাহমানী। ওই মামলায় আবার রিমান্ডেও নেয়।

মুফতি রাহমানী বলেন, আমার বংশে একমাত্র ছোট ভাই আবুল বাশার (বরিশালের একটি মাদরাসার প্রভাষক) গ্রেপ্তার হওয়া বাকি ছিল। নতুন বিয়ে করেছে সে। আমার মামলার কাজে স্ত্রীকে নিয়ে এক দিন ঢাকায় আসার পথে সদরঘাটে নামতেই তাকে কালো গাড়িতে নিয়ে যায়। তার স্ত্রীকে সোজা বরিশালে যেতে বলে। ছয় মাস পর্যন্ত ভাইয়ের কোনো খোঁজ ছিল না।

ঢাকায় জিডি করতে গেলে তা নেয়নি। পরে বরিশালে জিডি করে তার স্ত্রী। ছয় মাস ধরে নির্যাতন করে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সঙ্গে তার ভাই রাহমানীর সম্পৃক্ততার বিষয়ে জানার কথা স্বীকার করাতে চায়। কিন্তু তা স্বীকার না করায় তাকে পায়খানার রাস্তায় ডিম, রড ঢুকিয়ে, লিঙ্গের সঙ্গে পাঁচ কেজির বাটখারা ঝুলিয়ে রাখে। আমাকে সে কিছুই বলেনি। জেলখানার ডাক্তার এসব আমাকে বলেন। একপর্যায়ে সে মারা যায়। কিন্তু সে কথাও আমাকে জানায়নি। দেখতেও দেয়নি। মিজান সাগর নামের একজন কর্মকর্তা দেখা করতে দেননি। দুদিন এক কারারক্ষী পত্রিকা দিয়ে মৃত্যুর খবরটি পড়তে বলেন।

জেলে কষ্টের কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বরগুনা জেলে ফাঁসির সেলে রাখা হয়। ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে রাখা হয়। সাত মাস পর্যন্ত এভাবে রাখা হয়। বেড়ি টানতে টানতে আমার পা অবশ হয়ে যায়। বাইরের কোনো চিকিৎসা নেওয়ার সুযোগ দেয়নি। এভাবে তিন বছর পর্যন্ত পা ফুলে থাকে। তিন বছর পর পা শুকাতে থাকে। কিন্তু তখন পায়ের ক্যালসিয়ামসহ সবকিছু শুকাতে থাকে। এতে হাঁটা যায় না। পা অচলের মতো অবস্থা। এখন মুক্তির পর ঠিক তাই হয়েছে। হাঁটতে পারি না। চিকিৎসা নিতে হবে। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারেও ফাঁসির সেলে রাখা হয়।

নির্যাতিত এই আলেম বলেন, দীর্ঘ ১১ বছর পর সব মামলায় জামিন নিয়ে কাশিমপুর কারাগার থেকে বের হওয়ার সময় আবার আটক করে নিয়ে যায় সিটিটিসি। সেখানে গারদে রাখে। কয়েক দিন পর মোহাম্মদপুরে নিয়ে নাটক সাজায়। সন্ত্রাসবিরোধী মামলা দেয়। সেই মামলায়ও জামিন হলে তা আদালত স্টে করে দেয়। একপর্যায়ে আশাহত হয়ে গিয়েছিলাম যে, আমি হয়তো আর বের হতে পারব না। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছায় গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী পরিস্থিতিতে গত ২৬ আগস্ট মুক্তি পাই।

সূত্র: আমার দেশ 

No comments:

Post a Comment

ধর্ষণ থামছে না, ফেব্রুয়ারিতে দিনে গড়ে ১২টি মামলা। (BDC CRIME NEWS24)

BDC CRIME NEWS24 ধর্ষণ থামছে না, ফেব্রুয়ারিতে দিনে গড়ে ১২টি মামলা: (নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলা: ২০২৪: জানুয়ারি–জুলাই ১০,৭০৪টি, ২০২৪: আগস্ট...