Tuesday, December 31, 2024

সাজাপ্রাপ্ত সবাই গুম ও হেফাজতে নির্যাতনের ভিক্টিম-হোলি আর্টিজান ম্যাসাকার। (BDC CRIME NEWS24)

BDC CRIME NEWS24

সাজাপ্রাপ্ত সবাই গুম ও হেফাজতে নির্যাতনের ভিক্টিম-হোলি আর্টিজান ম্যাসাকার:

প্রকাশ : ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯: ০৬

স্বীকারোক্তি আদায়ে দেশে দেশে পুলিশের অনেক নৃশংস অত্যাচারের কথা শোনা গেলেও হোলি আর্টিজান হামলার তদন্তে নির্মমতার সব সীমা ছাড়িয়ে যাওয়ার অভিযোগ উঠেছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে।

২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানের ৭৯নং রোডের হোলি আর্টিজান বেকারিতে নৃশংস ম্যাসাকারে ২০ জন দেশি-বিদেশি জিম্মি, দুজন পুলিশ এবং পাঁচ কথিত অস্ত্রধারী ইসলামি জঙ্গি নিহত হয়। মামলার অভিযোগপত্রে জঙ্গিবাদের অভিযোগে পুলিশ ২১ জনকে আসামি করলেও তার মধ্যে ৮ জন পরবর্তীতে কথিত ক্রসফায়ারে পর্যায়ক্রমে নিহত হয়েছে। জীবিত ৭ আসামিকে ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনাল ২০১৯ সালের ২৭ নভেম্বর মৃত্যুদণ্ড দিলেও হাইকোর্ট ২০২৩ সালের ৩০ অক্টোবর সব আসামির সাজা কমিয়ে তাদের আমৃত্যু কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে।

ভয়াবহ সেই হামলায় সরাসরি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ এনে বিভিন্ন গ্রাম-গঞ্জের দরিদ্র পরিবারের কয়েকজন তরুণের জবানবন্দি আদায়ে ক্রসফায়ারের হুমকির পাশাপাশি তাদের স্ত্রী, শিশু-সন্তান, বয়স্ক মা-বাবাসহ অন্যান্য সদস্যকে মাসের পর মাস গুমের পাশাপাশি পরিবারের নারী সদস্যদের শ্লীলতাহানির ভয় দেখানোর অভিযোগ উঠেছে কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ও গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সদস্যদের বিরুদ্ধে।

গুম-সংক্রান্ত কমিশন অব ইনকোয়ারিতে আসামিদের স্বজনরা এ বিষয়ে আলাদা আলাদা অভিযোগ জমা দিয়েছেন। সেসব নথি বিশ্লেষণ এবং ভুক্তভোগী স্বজনদের সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে জোর করে স্বীকারোক্তি আদায়ে পুলিশের ভয়ংকর নির্মমতার চিত্র।

এ মামলায় আমৃত্যু সাজাপ্রাপ্তরা হলেন আসলাম হোসেন, ওরফে রাশেদ, ওরফে আবু জাররা, ওরফে র‍্যাশ, হাদিসুর রহমান সাগর, রাকিবুল হাসান রিগান, জাহাঙ্গীর আলম, ওরফে রাজীব, ওরফে রাজীব গান্ধী, আবদুস সবুর খান (হাসান), ওরফে সোহেল মাহফুজ, শরিফুল ইসলাম ও মামুনুর রশিদ।

দণ্ডপ্রাপ্তদের স্বজনরা আমার দেশকে বলেন, এ ঘটনায় জড়িত থাকার প্রমাণ আদালতে হাজির করতে পারেনি পুলিশ। কেবল নৃশংস কায়দায় নির্যাতনের মাধ্যমে তাদের স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়েছে এবং তার ভিত্তিতেই সাজা হয়েছে।

আমার দেশ-এর অনুসন্ধানেও মিলেছে এই মামলার তদন্তে ব্যাপক ত্রুটি, দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অকাট্ট প্রমাণের অভাব এবং নারী-শিশু ও বয়স্ক ব্যক্তিদের গুম করে বিভিন্ন কায়দায় শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের মাধ্যমে স্বীকারোক্তি আদায়ের লোমহর্ষক চিত্র।

গুম শ্লীলতাহানি ক্রসফায়ারের ভয়

এ মামলায় আমৃত্যু সাজাপ্রাপ্ত একজনের স্বজন আমার দেশকে জানান, আসামিদের স্ত্রীদের শ্লীলতাহানির ভয় দেখিয়ে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি আদায়ের ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া অনেক নারী ও শিশুকে তিন মাস থেকে এক বছর গুম করে রেখে তাদের সঙ্গে অমানবিক আচরণ করেছে পুলিশ।

স্বজনরা জানিয়েছেন, মামলার তদন্তে ১৬৪ ধারায় দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিকেই প্রধান হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। আর এই জবানবন্দি আদায়ে ভয়াবহ সব পন্থা অবলম্বনের অভিযোগে উঠেছে সিটিটিসি, ডিবি ও পুলিশের বিরুদ্ধে।

স্বজনরা জানিয়েছেন, অন্যতম আসামি জাহাঙ্গীর আলম, ওরফে রাজীব, ওরফে রাজীব গান্ধীর স্ত্রী ও সন্তানকে আট মাস ডিবি অফিসে গুম করে রাখা হয়েছিল। নানা ভয় দেখিয়ে তার স্ত্রীর ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায় করা হয়েছে।

অপর আসামি আব্দুস সবুরের স্ত্রীকে তুলে নিয়ে যাওয়ার ভয় দেখিয়ে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি আদায় করেছে পুলিশ। এভাবে প্রত্যেকের পরিবারের সদস্যকে তিন মাস থেকে এক বছর গুম রাখা হয়েছিল।

এছাড়াও মামলার অপর আসামি দিনমজুর হাদিসুর রহমান, ওরফে সাগরকে নির্মম নির্যাতনের মাধ্যমে অনেকটা পঙ্গু করে ফেলার পর তার ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি আদায় করা হয়েছে।

এ বিষয়ে রাজিবের বড় ছেলে আল মাহমুদ উসায়েদ গত ৩ ডিসেম্বর টেলিফোনে আমার দেশকে বলেন, ‘আব্বুকে যখন ধরেছিল, তখন আমি সাঘাটা মাদরাসায় পড়ি। আমার বয়স তখন আট বছর। আমাকে ফজরের সময় ধরে নিয়ে যায়। আম্মু আর আমার ছোট ভাইকেও আট মাস গুম রেখেছিল।’

বর্তমানে এসএসসি পরীক্ষার্থী এই কিশোর সেদিনের ঘটনা স্মরণ করে বলে, ‘ওসি আমাকে থানায় এক দিন আটকে রাখছে। থানায় ভয় দেখাইছিল। বলছে, সব না বললে সবাইকে নিখোঁজ করে দিব।’

রাজিবের স্ত্রী ও তাদের শিশুপুত্র মোহাম্মদ আব্দুল ওমরকে তখন ঢাকা থেকে তুলে নিয়েছিল ডিবি। ওমরের বয়স তখন ছিল সাড়ে চার বছর। এরপর তাদের ডিবি অফিসে আট মাস গুম করে রাখা হয়। তখন শিশু হলেও স্মৃতিপটে অনেক কিছুই স্পষ্ট মনে রেখেছে সে।

তোমাকে আর তোমার আম্মুকে ডিবিতে একসঙ্গে গুম রেখেছিল- এমন প্রশ্নের জবাবে এই কিশোর টেলিফোনে জানায়, ‘জ্বি।’

রাজীবের স্ত্রী মাহমুদা ডিবিতে তাকে ও তার শিশুসন্তানকে আট মাস গুম করে রাখার ঘটনা বর্ণনা করেছেন।

তিনি জানান, তার স্বামীকে সাত মাস একটি কক্ষে জানালার সঙ্গে হাতকড়া বাঁধা একটি টুলে বসিয়ে রাখতে দেখেছেন তিনি। টানা সাত মাস একইভাবে তাকে রেখেছিল।

তিনি বলেন, ‘পুলিশ বলত অপরাধ স্বীকার না করলে তোমার স্বামীকে বাঁচাইয়া রাখব না।’ আমি তখন তাদের বলি, ‘আমি কিছুই জানি না। আপনি এখন মারলেই কি, ক্রসফায়ার দিলেই কি। আমারে যদি আপনারা এখানে মাইরাও ফালান, তাও আমি কিছু করতে পারব না।’

পুলিশ আমাকে বলত, ‘তুমি এটা-ওটা স্বীকার করো। তাহলে তোমার স্বামী বাঁচবে। না হলে ক্রসফায়ার দিয়ে দেব। আর আমার স্বামীর মুখে শুনছি তাকে (পুলিশ) বলেছিল, ‘তুমি এটা-ওটা স্বীকার করো। তাহলে তোমার স্ত্রী-সন্তান বেঁচে যাবে।’

তিনি বলেন, ‘আমার স্বামী নির্যাতনেই সব স্বীকার করছে। ও স্বীকার করার পর ক্রসফায়ার বন্ধ হইয়া গেছে।’

রাজীবের স্ত্রী বলেন, ‘আমার মা-ভাই, ভাসুরের পরিবার, বড় ছেলে ও তার মাদরাসার হুজুর, ছোট শাশুড়ির ছেলে, আমার শাশুড়ি, ভাসুরের চার ছেলে ও এক মেয়েকে পুলিশ নিয়ে গেছিল।’

রাজীবের মতো অপর দণ্ডপ্রাপ্ত আব্দুস সবুর খানের স্ত্রী-সন্তানের ওপরও অমানবিক নির্যাতন নেমে এসেছিল।

ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৪২ ধারার বিধানমতে, আসামির লিখিত বক্তব্যে সবুর বলেন, ‘ক্রসফায়ারের হুমকি দিয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে বলে। প্রথম দফায় জবানবন্দি নিতে ব্যর্থ হওয়ায় দ্বিতীয় দফায় আমার স্ত্রী-সন্তানকে জিম্মি করা হয়। দীর্ঘ সময় ধরে ভয়ানক সব অত্যাচার-নির্যাতনের কারণে আমি শারীরিক ও মানসিকভাবে সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত হয়ে পড়ি। এ অবস্থায় আমার স্ত্রী-সন্তান এবং নিজের জীবন বাঁচানোর জন্য নিতান্ত নিরুপায় অবস্থায় পুলিশের তৈরি জবানবন্দির কাগজে স্বাক্ষর করি।’

স্ত্রী-সন্তানদের ওপর নির্মমতার একই ধরনের পদ্ধতি অবলম্বন করা হয় মামলার আরেক দণ্ডপ্রাপ্ত হাদিসুর রহমানের ক্ষেত্রেও।

ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৪২ ধারায় দেওয়া লিখিত বক্তব্যে পুলিশের নির্মমতার বর্ণনা দিয়ে হাদিসুর বলেন, ‘পুলিশ আমার স্ত্রী-ছেলেমেয়ের ছবি দেখিয়ে বলে, ‘এদের কথা কী তোর একটুও মনে হয় না? এদের জন্য মন কাঁদে না? এদের ভবিষ্যৎ নিয়ে তোর চিন্তা হয় না?’ আমি বলি, ‘স্যার আমাকে, আমার স্ত্রী-সন্তানদের ছেড়ে দিন’। তারা বলে, ‘তোকে, তোর স্ত্রীকে ছাড়ব একটি শর্তে- যদি রাজি হস, তাহলে। বড় স্যার এসে তোকে শর্ত জানাবে।’ এত নির্যাতন আর সহ্য হয় না। আমি বলি, ‘রাজি আছি’। পরদিন কয়েকজন অফিসার আসেন। এসে কয়েক পাতার কম্পিউটার টাইপ করা লেখা পড়তে বলেন। সেসব তারা মোবাইলে রেকর্ড করে নিয়ে যায়।’

দণ্ডপ্রাপ্ত আরেক আসামি মামুনুর রশীদ ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৪২ ধারার বিধানমতে লিখিত বক্তব্যে গুম, নির্যাতন ও ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে স্বীকারোক্তি আদায়ের অভিযোগ করেন।

স্বীকারোক্তি আদায়ে পুলিশ ও ম্যাজিস্ট্রেটের যোগসূত্রের অভিযোগ

ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায়ে পুলিশের সঙ্গে ম্যাজিস্ট্রেটের যোগসাজশের অভিযোগ উঠে এসেছে আমৃত্যু সাজাপ্রাপ্ত কয়েকজন আসামির বর্ণনায়।

আমৃত্যু সাজাপ্রাপ্ত আসামি সবুর খানের পক্ষে তার ভাই হাফিজুল ইসলাম গুম-সংক্রান্ত কমিশন অব ইনকোয়ারিতে জমা দেওয়া চিঠিতে তার ভাইকে গুমের পর নির্যাতন ও ম্যাজিস্ট্রেটের উদাসীনতার অভিযোগ তোলেন।

গুম-সংক্রান্ত কমিশনে সবুর লেখেন, ‘আমাকে ২০১৭ সালের ১০ মে আটক করে বগুড়া পুলিশ লাইনসে একটি ঘরে ১০-১২ দিন রাখে। সেখানে অমানুষিক নির্যাতন চালায়। এএসপি (পরে পদোন্নতি পেয়ে সিরাজগঞ্জের এসপি) আরিফুর রহমান মণ্ডল, এসআই জুলহাস এবং বগুড়া জেলার তখনকার এসপি আসাদুজ্জামান (পরে সিটিটিসির প্রধান) জিজ্ঞাসাবাদের নামে ভয়ঙ্কর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করতেন।’

সবুর বলেন, ‘পরে বগুড়া ডিবি ঢাকায় মিন্টো রোডের সিটিটিসির অফিসে রেখে আসে। সেখানে এক মাস পর্যন্ত আটকে রেখে জিজ্ঞাসাবাদের নামে নির্যাতন চালায়। আমাকে রাখা হয়েছিল সিটিটিসির এসি শাহেদের ইউনিটের অধীনে। তখন সিটিটিসির ডিসি ছিলেন মুহিবুল ইসলাম। সিটিটিসির প্রধান ছিলেন মনিরুল ইসলাম।’

তিনি বলেন, ‘রিমান্ডে অমানবিক নির্যাতন আর ক্রসফায়ারের হুমকি দেওয়া হয়। নিজেদের মতো করে একটা গল্প লিখে আমাকে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে নিয়ে যায়। ম্যাজিস্ট্রেট আমার কাছ থেকে কিছু না শুনেই স্বাক্ষর নেন।’

ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৪২ ধারার বিধানমতে আসামি হাদিসুর রহমানের লিখিত বক্তব্যেও উঠে এসেছে স্বীকারোক্তি আদায়ের চাঞ্চল্যকর বর্ণনা।

হাদিসুর বলেন, ‘সেই নির্যাতন যে কী বর্বরোচিত, ভয়াবহ ছিল, তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। আমাকে বলে উঠে দাঁড়া। আমি দাঁড়াতে পারছিলাম না। পায়ের তালু ফুলে কালো হয়ে গেছে; রক্ত জমাট ছিল। কোনো শক্তি ছিল না। এক মহিলা পুলিশ এসে বলেন, ভাই আপনি নির্যাতন সহ্য করতে পারবেন না। স্যার যা বলে তা-ই শোনেন। বেঁচে থাকলে স্ত্রী, ছেলেমেয়ের সঙ্গে দেখা করতে পারবেন। মরে গেলে তো তারা এতিম হয়ে যাবে, কোনটা ভালো?’

তার পরের ঘটনা শুনুন হাদিসুরের ভাষায়,

‘…ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে এসি ইমরান বসে ছিলেন। ম্যাজিস্ট্রেট পুলিশকে বলে, কী আনছেন দেন। পুলিশ তখন টাইপ করা কাগজ ম্যাজিস্ট্রেটকে দেয়। ম্যাজিস্ট্রেট বলেন স্বাক্ষর কর। আমি বলি, না পড়ে আমি স্বাক্ষর করব না। ম্যাজিস্ট্রেট পুলিশকে চোখ টিপ দিয়ে বলেন, একে নিয়ে যান। পুলিশ আমাকে ম্যাজিস্ট্রেটের খাসকামরার পাশে বাথরুমে নিয়ে গিয়ে হাত-পা, চোখ-মুখ বেঁধে নির্যাতন করে, বুট দিয়ে লাথি দিয়ে আমার পায়ের আঙ্গুল থেঁতলে দেয়। একটু পর আবার ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে নিয়ে আসে। তখনও পুলিশ অফিসার ম্যাজিস্ট্রেটের কামরায় ছিলেন।’

‘এরপর আমি ম্যাজিস্ট্রেটকে বলি, স্যার, আপনার সঙ্গে আমি কথা বলব। ম্যাজিস্ট্রেট পুলিশকে বাইরে যেতে বলেন। আমি ম্যাজিস্ট্রেটকে বলি, স্যার দেখেন আমাকে কী নির্যাতন করেছে, আমার পায়ের আঙ্গুল থেঁতলে দিয়েছে। ম্যাজিস্ট্রেট তখন বলেন, স্বাক্ষর দে বাবা, না হলে আরও বেশি মারবে। এ কথা শুনে আমি হতবাক হয়ে যাই। বলি, স্বাক্ষর করব না। ম্যাজিস্ট্রেট তখন বলেন, এ স্বাক্ষর করবে না। একে নিয়ে যান, আচ্ছামতো বানাবেন; কোনোরকম যেন বেঁচে থাকে। এরপর কোর্ট গারদে জমা দিয়ে যাবেন।’

স্বীকারোক্তি আদায়ে পুলিশের নির্মমতা বর্ণনা করেন আমৃত্যু সাজাপ্রাপ্ত আসামি আসলাম হোসেন।

তিনি বলেন, ‘ডিবিতে নির্যাতন করতে করতে আমার নাক দিয়ে অনেক রক্ত ঝরতে শুরু করে। বৈদ্যুতিক শক এবং লজ্জাস্থানে ইট ঝুলিয়ে রাখত কখনো কখনো। ফলে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়। হুমায়ুন কবির, এডিসি নাজমুল, এসি ইমরান আমাকে বলে, তোকে ১৬৪ দিতে হবে।’

গুম কমিশনে একই ধরনের অভিযোগ দেন আমৃত্যু সাজাপ্রাপ্ত শরিফুল ইসলামের ছোট ভাই আরিফুল ইসলাম।

শরিফুল বলেন, ‘আমাকে দড়ি দিয়ে হাত-পা বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা, লাঠি দিয়ে বেধড়ক পেটানো, ইলেকট্রিক চেয়ারে বসিয়ে শক দেওয়া, সারাদিন পেছনে হাতমোড়া করে হাতকড়া লাগিয়ে টুলে বসিয়ে রাখা– এমন নানান নির্যাতন করেছে। এছাড়া এমন একটি মেশিন ছিল, যেখানে প্রথম দাঁড় করিয়ে শরীরকে মেশিনের সঙ্গে বাঁধা হয়। পরে হাঁটুতে, কোমরে, বুকে ও মাথায় বেঁধে তারপর ওই মেশিন ঘোরাতে শুরু করে। অনেকটা লঞ্চ-স্টিমার বা জাহাজের হুইলের মতো। পুরো শরীর তখন ওই মেশিনের সঙ্গে ঘড়ির কাঁটার মতো ঘুরতে থাকে।’

মানবাধিকারকর্মী ও আইনজীবীদের ভাষ্য

স্বজনদের গুম, স্ত্রীদের শ্লীলতাহানির ভয় দেখিয়ে স্বীকারোক্তি আদায়ের এমন বর্বর পদ্ধতির বিষয়ে হংকংভিত্তিক এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশনের সাবেক কর্মকর্তা এবং যুক্তরাষ্ট্রের ওহিও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং ইন্টারন্যাশনাল স্কলার মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান আমার দেশকে বলেন, ‘রাজনৈতিক দুরভিসন্ধিমূলক মামলায় আটক ব্যক্তিদের পরিবারের নারী সদস্যদের সম্ভ্রমহানির ভীতি প্রদর্শন এবং বাবা-মা, সহোদর ও সন্তানদের জিম্মি করে জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি আদায়ের নজির এশিয়া ও বিশ্বের অন্যান্য দেশে থাকলেও বাংলাদেশে শেখ হাসিনার সময়কালে এমন ন্যক্কারজনক সংস্কৃতি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়।’

তিনি বলেন, ‘আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর হেফাজতে নির্যাতন চালিয়ে স্বীকারোক্তি আদায়ের ঘটনা মানবাধিকার ও ন্যায়বিচারের নীতিমালার সুস্পষ্ট লংঘন হলেও এই ক্যানসার সমতুল্য পদ্ধতি বাংলাদেশের ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে আছে।’

এই মানবাধিকারকর্মী আরও বলেন, ‘ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করার প্রক্রিয়ার ওপর আইনগতভাবে ম্যাজিস্ট্রেটদের পূর্ণ স্বাধীনতা থাকা সত্ত্বেও তারা ক্ষমতাসীন সরকার ও আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর সঙ্গে নিজেদের সমর্পণ করার বিনিময়ে অযাচিত সুবিধা প্রত্যাশা করে থাকেন। বিচার বিভাগের সামগ্রিক স্বাধীনতার প্রতি নির্বাহী বিভাগের অশ্রদ্ধা, রাষ্ট্রের তিনটি প্রধান স্তম্ভের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হিসেবে অপর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ, রাজনৈতিক আনুগত্যনির্ভর নিয়োগ, পদায়ন ও পদোন্নতির প্রাতিষ্ঠানিকতার মাধ্যমে স্বাধীন মানসিকতা এবং আত্মমর্যাদাবোধ বাংলাদেশের বিচারকদের মাঝে দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া প্রকৃতপক্ষে গড়ে ওঠেনি। ফলে গোটা জনগোষ্ঠী বিচারহীনতা ও অবিচারের শিকার হয়ে চলেছে। দেশের বিচারব্যবস্থাকে আমূল পরিবর্তন করতে হবে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য ন্যায়বিচারের মানদণ্ড সমুন্নত রাখার অবকাঠামোগত, জনবল ও আর্থিক সক্ষমতা নিশ্চিতের পাশাপাশি জনপরিসরে বিচারকদের বিচার প্রক্রিয়ার নির্মোহ এবং গঠনমূলক সমালোচনার সুযোগ থাকতে হবে।’

বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শেখ ওমর আমার দেশকে বলেন, ‘এই মামলায় আসামিদের জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি আদায়ের ক্ষেত্রে কোনো কোনো ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক পুলিশকে সহযোগিতা করার বিষয়টি অসম্ভব নয়। শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশের সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করা হয়েছিল। বিচার বিভাগেও একটি বড় সংখ্যার বিচারক স্বৈরাচারের পদলেহনে ব্যস্ত ছিল।’

হোলি আর্টিজান হামলায় সরাসরি জড়িত তরুণদের সবাই ঘটনাস্থলে এবং পরবর্তীতে তাদের সহযোগীদের সবাই পুলিশ-ডিবির তথাকথিত ক্রসফায়ারে নিহত হন। তাদের নিহত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই হামলার নেপথ্যের কারিগরদের অনেক রহস্যের উন্মোচন হয়নি। অন্ধকারে হারিয়ে গেছে অস্ত্র ও অর্থদাতাদের আসল পরিচয়। হামলার মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে কানাডার নাগরিক তামিম চৌধুরীকে গণমাধ্যমে হাইলাইট করা হলেও তার পৃষ্ঠপোষকতা কিংবা এই হামলা আদৌ ‘অপারেশন স্টিং’ ছিল কি না- সেসবের কোনো জবাব মেলেনি।

জুলাই গণহত্যার পরই কুখ্যাত ওইসব পুলিশ কর্মকর্তা পালিয়ে গেছেন। কেউ কেউ গ্রেপ্তার হয়েছেন।

গুম করে নির্মম নির্যাতনের বিষয়ে বগুড়ার তখনকার এএসপি আরিফুর রহমান মণ্ডলকে ফোনে পাওয়া যায়নি। তাকে খুদেবার্তা দেওয়া হলেও তার কোনো জবাব মেলেনি।

সূত্র: আমার দেশ 

No comments:

Post a Comment

এনএসআইয়ে ‘র’ নেটওয়ার্ক। (BDC CRIME NEWS24)

BDC CRIME NEWS24 এনএসআইয়ে ‘র’ নেটওয়ার্ক: প্রকাশ : ১৯ আগস্ট ২০২৫, ০৮: ২৭ বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআইয়ের অভ্যন্তরে ২০০৯ ...