BDC CRIME NEWS24
হাতকড়া থাকার পরও পরানো হয় ডান্ডাবেড়ি:
প্রকাশ : ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১: ৩৯
আওয়ামী শাসনামলে যেসব আলেম সরকারের নিপীড়নের শিকার হয়েছিলেন, তাদের অন্যতম রাজধানীর জামিয়া মাদানিয়া বারিধারার মুহতামিম ও হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের অর্থ সম্পাদক মুফতি মনির হোসাইন কাসেমী। বছরের পর বছর নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তিনি। তার নিজের জীবন যেমন তছনছ হয়েছে, তেমিন ভীষণ ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছেন তার সন্তানরাও।
নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে আমার দেশকে তিনি বলেছেন, ‘কারাগারে নানাভাবে দুর্ভোগে দিন পার করতে হয় আমাকে। সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগের শিকার হতাম কোর্টে যাওয়ার সময়। হাতকড়া থাকার পরও আবার দুই পায়ে ডান্ডাবেড়ি পরানো হয়। গারদ থেকে কোর্টে ওঠানোর সময় আবার অতিরিক্ত রশি দিয়ে বাঁধা হতো। যতক্ষণ কোর্টে থাকতে হয়, ততক্ষণ এ অবস্থায়ই দিন কাটে। এমনকি কোনো কোনো সময় পরের দিন পর্যন্ত এভাবে রাখা হতো। এ সময় অজু-নামাজের সুযোগ ছিল না। সবচেয়ে মানহানিকর, কষ্টকর ছিল এটা।’
২০২১ সালে দেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে আমন্ত্রণ জানানোর প্রতিবাদ করায় আলেমদের গণগ্রেপ্তারসহ নানা নির্যাতনের শিকার হতে হয়। তাকে কোনো মামলা ছাড়াই আটক করে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর দেওয়া হয় বহু মামলা। দিনের পর দিন রিমান্ডের নামে তার ওপর চলে অমানুষিক নির্যাতন। নানা ভয়ভীতিও দেখানো হয় তাকে। এভাবে দীর্ঘ আড়াই বছর কারাগারে কাটান দেশের অন্যতম শীর্ষ এই আলেম।
মুফতি কাসেমী হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় অর্থ সম্পাদক হিসেবে ধর্মীয় ইস্যুতে বিভিন্ন আন্দোলনে রাজপথে সক্রিয় ছিলেন। এজন্য সব সময় আওয়ামী লীগ সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর নজরদারি ছিল তার ওপর। সব সময় গ্রেপ্তার আতঙ্কে থাকতেন তিনি। তার ওপর নির্যাতনের পাশাপাশি তার পরিবারেও নেমে আসে নানা সংকট। সন্তানদের লেখাপড়ায় ছন্দপতনসহ চরম আর্থিক সংকটে পড়েন তিনি।
আমার দেশকে মুফতি কাসেমী বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল আর আলেম-ওলামারা সুখে ছিল এরকম ইতিহাস নেই। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে তারা নাস্তিকদের উসকে দিয়েছিল। তসলিমা নাসরিনের উত্থান তখনই হয়েছিল। ফতোয়াবিরোধী রায় তখনই হয়েছিল। তখনও অনেক আলেম-ওলামা জেল-জুলুম, নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। তারই ধারাবাহিকতায় ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসার পর জুলুম নির্যাতন চালায়। অন্যবার শুধু আলেম-ওলামা নির্যাতিত হলেও এবার দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে দিয়ে শুরু করে। ৫৬ জন চৌকস সেনা কর্মকর্তাকে হত্যার মতো ঘৃণ্যতম কাজের মধ্য দিয়ে মুসলিম জাতিসত্তার ওপর বড় আঘাত হানে তারা।’
‘এরপর একের পর এক নাস্তিকদের আস্ফালন, তাদের লালন শুরু হয়। এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো শাহবাগ। ইমরান এইচ সরকারের নেতৃত্বে ইতিহাসের সবচেয়ে ঘৃণ্যতম-নোংরা কাজগুলো সেখানে হয়েছে। তারা আলেম-ওলামা, দাড়ি-টুপি নিয়ে, এমনকি রাসুল (সা.)-কে নিয়ে পর্যন্ত কটূক্তি করার দুঃসাহস দেখিয়েছে। এমনই এক পর্যায়ে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের উত্থান ঘটে। আর ওই হেফাজতকে দমন করতে গিয়ে ২০১৩ সালের ৫ মে তারা পৈশাচিক নির্মম নির্যাতন চালিয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আলেম ও মুসলমানদের ওপর জুলুম-নির্যাতনের জন্য আওয়ামী লীগ সরকার অজুহাতের তালাশে থাকতো। পায়ে পাড়া দিয়ে অজুহাত তৈরি করা হতো। এজন্য তারা প্রথমত, মাদ্রাসাগুলোকে টার্গেট করে। প্রকাশ্যে বন্ধের সাহস না পেলেও কৌশলে নানা চক্রান্ত করে সরকার। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় বলেই ফেলেছিল যে, মাদ্রাসা সংকুচিত করার কাজ আমরা শুরু করেছি। তার এ কথার পরই কুরবানির চামড়ার দাম কমিয়ে দেওয়া হয়। এতে মাদ্রাসাগুলো আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে আল্লাহর রহমতে এখন মাদ্রাসা ও শিক্ষার্থী সংখ্যা তিনগুণ বেড়ে গেছে। তারা ওয়াজ মাহফিল ও মসজিদের মিম্বারগুলো টার্গেট করে। কোনো আলেমকে স্টেজে বসে স্বাধীনভাবে কথা বলার সুযোগ রাখেনি। মাইক কেড়ে নেওয়া, শারীরিকভাবে আক্রমণের মতো ঘৃণ্যতম কাজ তারা করেছে। ইমামরা হুমকি-ধমকির মধ্যে থাকতেন, ইমামতি বন্ধ করে দেওয়া হতো। এসবের জন্য ইসলামিক ফাউন্ডেশনকে তারা খুব খারাপভাবে ব্যবহার করেছে।
তিনি বলেন, ‘সবচেয়ে খারাপ কাজ হয়েছে ২০২১ সালে স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে আমন্ত্রণ জানানোর পর। মোদির সরাসরি নির্দেশে ভারতে মুসলিম নিধনের কাজ হয়েছে। আলেমদের দাবি ছিল ভারতের অন্য কাউকে আমন্ত্রণ করা হোক। মুসলমানদের রক্তে যার হাত রঞ্জিত তিনি যেন না আসেন। কিন্তু সরকার তা না করে উল্টো আলেমদের নির্বিচারে নির্যাতন করে। গণতান্ত্রিক অধিকার হিসেবে একটি হরতাল ডাকাকে কেন্দ্র করে হেফাজত নেতাদের গণহারে গ্রেপ্তার করে। রমজান মাসকেও তারা ভ্রুক্ষেপ করেনি। ৩ রমজান থেকে শুরু করে হাজার হাজার আলেমকে গ্রেপ্তার করে মিথ্যা-বানোয়াট মামলা দেয়, যেগুলো এখনো প্রক্রিয়াধীন আছে। মানবাধিকার বলতে কোনো কিছুর চিহ্নই ছিল না আলেমদের ক্ষেত্রে। খুনি, চোর, লুচ্চাদেরও সপ্তাহে একদিন স্বজনদের সঙ্গে দেখা করা, টেলিফোনের সুযোগ পায়, কিন্তু আলেমদের সেই অধিকারও ছিল না।’
নিজের গ্রেপ্তার-নির্যাতন প্রসঙ্গে মুফতি কাসেমী বলেন, ‘আলেমদের গণগ্রেপ্তারের ধারাবাহিকতায় সরকারের লোকেরা মনে করেছিল যে, আমি হেফাজতের কেন্দ্রীয় অর্থ সম্পাদক, আমাকে না গ্রেপ্তার করলে কেমন হয়! ২০২১ সালে রোজার ঈদের পর আমি সাহস করেই বারিধারা মাদ্রাসায় হাজির হই। সেখানে মাগরিবের পর মাদ্রাসার একটি মিটিং চলা অবস্থায় ডিবি পুলিশ আমাকে আটক করে নিয়ে যায়।’ ‘ওইদিন আমি রোজা অবস্থায় ছিলাম। শুধু খেজুর আর পানি দিয়ে ইফতার করেছিলাম। তখনও রাতের খাবার খাইনি। আমাকে আটক করে মিন্টো রোডের ডিবি অফিসে নিয়ে যায়। টানা ৯ দিন পর্যন্ত সেখানে রাখা হয়। চারটি মামলায় ৯ দিন রিমান্ডে নেয়। অথচ আমার নামে আগে কোনো মামলা ছিল না, সব মামলা একদিনেই সাজানো হয়। রিমান্ডের এই ৯ দিন বিভিন্ন থানা ও গারদে কাটিয়েছি। সেখানে হেরোইনখোরদের সঙ্গেই নোংরা পরিবেশে রাখা হতো। যেখানে ১০ জন মানুষ বসতে পারবে না, সেখানে ২৫-৩০ জনকে গাদাগাদি করে রাখা হয়। প্রচণ্ড গরমের মধ্যে রাখা হতো। আমার বিরুদ্ধে ৯টি মামলা দেওয়া হয়। অনেকের নামে মামলা আরও বেশি দেয়। বিভিন্ন মামলায় আরও কিছুদিন রিমান্ডে ছিলাম।’
হেফাজতের এই নেতা বলেন, ‘আমি জামিনের জন্য খুব বেশি পীড়াপীড়ি করিনি। প্রথম দেড় বছর কারাগারে চুপচাপ কাটিয়েছি। কারণ, তখন একটা রীতিই ছিল যে, কারও একটি মামলায় জামিন হলে নতুন করে মামলা দেওয়া হতো। আমি জামিনের জন্য আবেদন না করায় নতুন মামলা দেয়নি। তবে মজার বিষয় হলো, যেদিন মুন্সীগঞ্জ বা চট্টগ্রামের মামলা দেওয়া হয়, একই দিনে পল্টনেও মামলা হয়। তারা খেয়াল করেনি যে, একই দিনে আমি ঢাকা ও চট্টগ্রামে কীভাবে ঘটনা ঘটালাম? এ হাস্যকর কাজও তাদের মাধ্যমে হয়েছে। আমাদের কারও সঙ্গে দেখা করতে দিতো না, পত্র-পত্রিকা দেওয়া হতো না।’
তিনি বলেন, ‘আরেকটি বিষয় সব সময় মনে প্রশ্ন জাগতো যে, এতবার আমাকে কোর্টে উঠানো হলো, এতগুলো মামলা দেওয়া হলো একটিবারের জন্যও কোনো বিচারক আমার কাছে জিজ্ঞাসা করলেন না যে, আমি কোনো অপরাধ করেছি কি না। কী অদ্ভুত বিচারব্যবস্থা! আমাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। সরকার পক্ষের আইনজীবীরা তাদের মনগড়া সব অভিযোগ পড়ে শোনান, সবচেয়ে মিথ্যাচার হলেও বিচারক আমাকে কিছু জিজ্ঞাসা না করেই আদেশ দিতেন। আমার আইনজীবীরাও তেমন কিছু বলার সুযোগ পেতেন না। তাদের কথা শেষ করার আগেই রায় হয়ে যেত। এভাবে আমি আড়াই বছর জেল খাটলাম। আরও সাত বছর এর প্রভাব পড়েছে আমার জীবনে। ১০টি বছর আমার জীবন থেকে চলে গেল বিনা অপরাধে। আমার মতো শত শত আলেমের একই অবস্থা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের সময় অফিসারদের ভাষা যে কত নোংরা হতে পারে, তা বলার মতো না। তাদের ভাষায় মনে হয়নি তারা বাংলাদেশের মানুষ। রক্তমাংসে বাংলাদেশের হলেও ভাষা শুনে তাদের অন্য দেশের মনে হয়েছে। সেখানে ডিবি, ডিজিএফআই ও এনএসআইয়ের লোক থাকতো। যেসব কথা জিজ্ঞাসা করতো তা হাস্যকর। জামায়াত-বিএনপির সঙ্গে আমাদের কী সম্পর্ক? ভারতের সঙ্গে কী সম্পর্ক জানতে চায়। নানা ভয়ভীতি দেখানো হয়। সামনেই নির্যাতনের অনেক জিনিসপত্র রাখা থাকতো। মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী, মাওলানা হারুন ইজহারকে পায়ের নখ থেকে শুরু করে বিভিন্ন জায়গায় নির্যাতন করা হয়।’
দীর্ঘ ৩১ মাস পর ২০২৩ সালের নভেম্বরে মুক্তি পান মুফতি কাসেমী। তিনি বলেন, জামিন ঘিরে তখন পুলিশ-আদালত একটা বাণিজ্য খুলে বসেছিল। সবার কাছ থেকে তারা অনেক টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। অনেকের ৪০-৫০ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। আমার জানামতে, একজন ৮০ লাখ টাকা খরচ করেছেন কারামুক্তির জন্য।
১৯৭২ সালে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় জন্মগ্রহণকারী মুফতি কাসেমী কওমি ধারায় উচ্চশিক্ষা নিয়েছেন ভারতের দেওবন্দ মাদ্রাসা থেকে। ১৯৯১ সালে বারিধারা মাদ্রাসায় শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে কর্মজীবন শুরু হয়। দুই বছর পর চলে যান সৌদি আরবে। ১৮ বছর সেখানে অবস্থানের পর ২০০৯ সালে দেশে ফিরে আবার একই মাদ্রাসায় মুহাদ্দিস হিসেবে জয়েন করেন। প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমীর মৃত্যুর পর প্রিন্সিপাল (মুহতামিম) হিসেবে দায়িত্বে আছেন মুফতি মনির হোসাইন কাসেমী।
কারাবন্দিত্বের প্রভাব নিজের পরিবারের ওপরও ব্যাপকভাবে পড়েছে বলে জানান মুফতি কাসেমী। তিনি বলেন, আমার বড় ছেলে চেন্নাইয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং চতুর্থ বর্ষে পড়তো। আমার গ্রেপ্তারের পর পরিবারের পাশে দাঁড়াতে সে পড়াশোনা শেষ না করেই দেশে চলে আসে। ছোট ছেলেটাও এসএসসির পর সময়মতো কলেজে ভর্তি হতে পারেনি।
সূত্র: আমার দেশ
No comments:
Post a Comment