BDC CRIME NEWS24
‘দীনহীন’ সেই এমপির অন্ধকার অতীত:
প্রকাশ : ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১: ০৫
জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে সব সংসদ সদস্যই গাড়িতে চেপে সংসদ ভবনে প্রবেশ করলেও ব্যতিক্রম ছিলেন মো. আজিজুল ইসলাম। যশোর-৬ (কেশবপুর) আসন থেকে নির্বাচিত এই তরুণ গত ৩০ জানুয়ারি বিকালে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় চেপে হাজির হয়েছিলেন সংসদ ভবনে। বিরোধীদলবিহীন ওই ‘আমি আর ডামির’ নির্বাচনে বিজয়ীদের মধ্যে আজিজুল ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ।
তরুণ এই সংসদ সদস্যের ‘দীন-হীন অবস্থা’ নিয়ে গণমাধ্যমে খবর প্রচারিত হয়; যেখানে জানানো হয়, আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী যশোরের ‘গডফাদার’ শাহীন চাকলাদারকে হারিয়ে সংসদ সদস্য হয়েছেন আজিজুল। দেশজুড়ে রাতারাতি আলোচনায় আসা আজিজুলকে অনেকেই ব্যাপক জনপ্রিয় ও জনবান্ধব তরুণ নেতা হিসেবে ভাবতে থাকেন।
তবে এই নেতার রয়েছে এক অন্ধকার অতীত। কেশবপুরের মানুষের জীবন অতিষ্ঠ করে দেওয়া কথিত হাতুড়ি বাহিনীর প্রধান হিসেবে এলাকায় প্রতিপত্তি অর্জন করেছিলেন আজিজুল। প্রভাবশালীদের তদবিরে ‘ক্রসফায়ার’ থেকে বেঁচে গেলেও জননিপীড়ক এই তরুণের নাম সংসদ সদস্যের তালিকায় উঠলে আফসোসের সঙ্গে এক পুলিশ কর্মকর্তার মন্তব্য ছিল, ‘দুদিন আগেও এই দুর্বৃত্তকে ধরে এনে চোরের মতো পিটিয়েছি। এখন তাকে স্যার ডাকতে হবে!’
কেশবপুর শহরের ব্রহ্মকাটি এলাকার খন্দকার রফিকুজ্জামান ও ফরিদা বেগমের ৯ সন্তানের মধ্যে আজিজ কনিষ্ঠ। এলাকাবাসী জানান, নিম্নবিত্ত রফিকুজ্জামানের চার ছেলেই কায়িক শ্রম দিয়ে জীবন ধারণ করতেন। মাদ্রাসা থেকে সাধারণ শিক্ষায় আসা আজিজ একপর্যায়ে ছাত্রলীগে যুক্ত হন। শুরু হয় তার অপকর্ম। কেশবপুর আসনের তৎকালীন সংসদ সদস্য ও জাতীয় সংসদের হুইপ অধ্যক্ষ আব্দুল ওহাব এবং পরে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ইসমত আরা সাদেক তাকে লুফে নেন।
এমপি ওহাবের প্রশ্রয়ে দ্রুতই বেপরোয়া হয়ে ওঠেন আজিজ। গঠন করেন কুখ্যাত ‘হাতুড়ি বাহিনী’। তার ভাই শরিফুলের নেতৃত্বে গঠিত হয় আরেকটি কুখ্যাত গ্যাং ‘গামছা বাহিনী’। হাতুড়ি বাহিনীর সদস্যদের কোমরে গোঁজা থাকত হাতুড়ি, যা দিয়ে তারা আক্রমণ করত টার্গেট করা মানুষকে। গামছা বাহিনীর সবার কাছে অস্ত্রশস্ত্রের পাশাপাশি থাকত গামছা। এই দুই বাহিনীর নির্যাতনে কেশবপুরের মানুষের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল হাসিনার শাসনামলে। বাহিনীর যখন দোর্দণ্ড প্রতাপ, তখন তাদের বুক দিয়ে আগলে রেখেছিলেন এমপি ইসমত। তাদের দৌরাত্ম্য এতটাই বেড়েছিল যে, সাংবাদিক এমনকি নারী পর্যন্ত রেহাই পাননি।
২০১০ সালে দিনের বেলা চাঁদার দাবিতে কেশবপুর বাজারে আইদ হোসেন নামে এক কাঠ ব্যবসায়ীর ওপর হামলা করে তার মোটরসাইকেলে আগুন ধরিয়ে দেয় ‘হাতুড়ি বাহিনীর’ সদস্যরা। খবর পেয়ে সেখানে ছুটে যান হাজি রুহুল কুদ্দুস, যিনি দৈনিক ইনকিলাবের কেশবপুর উপজেলা প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত। খানিকটা দূর থেকে ঘটনার ছবি তুলছিলেন রুহুল কুদ্দুস। এতেই কপাল পোড়ে তার। দুর্বৃত্তরা হামলা করে রুহুলের ওপরও। তাকেও হাতুড়িপেটা করে আহত করে। ব্যবসায়ী আইদের মাথাসহ সারা শরীরে এখনো ধারালো অস্ত্র ও হাতুড়ির আঘাতের চিহ্ন। আমার দেশকে তিনি তা দেখালেনও। আফসোস করে বললেন, ‘রুহুল সাংবাদিক হওয়ায় তার মামলাটা পুলিশ নিতে বাধ্য হয়েছিল। আমি তো আর সাংবাদিক না। তাই আমার মামলা তো নেয়নি, উল্টো আহত অবস্থায় আমাকে ঢুকিয়ে রাখে গরাদে।’
কুখ্যাত হাতুড়ি বাহিনীর সুলুকসন্ধানে কেশবপুরে গেলে বহু মানুষ ছুটে আসেন তাদের ওপর চালানো অত্যাচার-নিপীড়নের বর্ণনা দিতে। তাদের দেওয়া লোমহর্ষক বর্ণনা লিখে শেষ করার নয়। এমনকি হাসিনা সরকার পতনের আগের দিনও তারা ছাত্র-জনতার ওপর হামলে পড়ে হায়েনার মতো।
জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল কেশবপুর উপজেলা শাখার সাবেক সভাপতি ও বর্তমানে পৌর বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক আব্দুল হালিম অটল। তিনি বলেন, ‘গত ৪ আগস্ট বিএ সার্টিফিকেট তুলতে কেশবপুর কলেজে যাই। খবর পেয়ে ২৬-২৭টি মোটরসাইকেল নিয়ে সেখানে হাজির হয় আজিজের হাতুড়ি বাহিনীর সদস্যরা। তারা ক্যাম্পাসে ঢুকে আমাকে ধরে হাতুড়িপেটা করে। একপর্যায়ে আমি পাশের নালায় পড়ে যাই। মারা গেছি ভেবে তারা আমাকে ফেলে রেখে যায়। পরে স্থানীয়রা উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়। হাতুড়িপেটায় আমার বুকের পাঁজর ভেঙে যায়। এখনো সুস্থ হতে পারিনি।’
অটল জানান, একই দিন হাতুড়ি বাহিনী কলেজ ক্যাম্পাসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সংগঠক মিরাজকে পেটায় । ছাত্রদলের সাবেক নেতা পলাশের ওপরও তারা হামলা চালায়। পলাশ দৌড়ে পাশের একটি ঘেরে গিয়ে আশ্রয় নিলে সেই পর্যন্ত ধাওয়া করে হাতুড়ি বাহিনীর সদস্যরা তাকে ছুরি মারে।
আক্রান্ত পলাশ বলছিলেন, পিস্তল হাতে তার ওপর হামলায় নেতৃত্ব দিয়েছিল এমপি আজিজের ভাই শরিফুল। সঙ্গে ছিল খুলনার কুখ্যাত সন্ত্রাসী বিপ্লব, কেশবপুরের কবির, জামির, পারভেজ, তানজির, সুজন প্রমুখ। দুর্বৃত্তরা তার পেটের তিন জায়গায় ছুরি মারে। খুলনায় চিকিৎসা শেষে তিনি কোনোমতে প্রাণ নিয়ে ফিরতে পেরেছেন।
একই দিন হাতুড়ি বাহিনীর আলাদা হামলায় পৌর ছাত্রদলের আহ্বায়ক খায়রুল ইসলামসহ আহত হন অন্তত ২০ জন। ছাত্রদল, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জনতার প্রতিরোধের মুখে একপর্যায়ে পিছু হটে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের (ইউএনও) হলরুমে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিল এমপির সন্ত্রাসী বাহিনী। খায়রুল ইসলাম অভিযোগ করেন, তৎকালীন ইউএনও তুহিন হোসেন সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার না করে জনতার আক্রোশ থেকে রক্ষা করেছিলেন। ইউএনও তুহিন এখন কোথায় আছেন, সেই হদিস না পাওয়ায় তার বক্তব্য জানা যায়নি।
নারীদের ওপরও হামলা করতে দ্বিধা করত না আজিজের হাতুড়ি বাহিনী। আক্রান্ত নারীদের মধ্যে উপজেলা মহিলা দলের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক মহিলা কাউন্সিলর বিউটি বেগমের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘আমি বাড়িতে ছোট একটা দোকান চালাই। দোকানের জন্য মালামাল কিনতে ৪ আগস্ট বাজারে গিয়েছিলাম। আমাকে পিটিয়ে রক্তাক্ত করে আজিজের হাতুড়ি বাহিনীর খালিদ, শরিফুল, জামালসহ ২০-২৫ সদস্য। কেশবপুর বাজারের জমজমাট জায়গায় শত শত মানুষের সামনে এই ঘটনা ঘটলেও সন্ত্রাসীদের ভয়ে কেউ আমাকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসেনি।’
কেশবপুর পৌর বিএনপির সভাপতি ও পৌরসভার সাবেক দুবারের মেয়র আব্দুস সামাদ বিশ্বাস উল্লিখিত ঘটনাগুলো সত্য বলে নিশ্চিত করেন। আমার দেশকে এই বর্ষীয়ান নেতা বলেন, ‘অধ্যক্ষ আব্দুল ওহাব স্থানীয় এমপি থাকাকালে আজিজের সন্ত্রাসী কার্যকলাপ শুরু হয়। পরে ইসমত আরা সাদেক এমপি হলে তার দৌরাত্ম্য আরও বাড়ে। আমি মেয়র থাকাবস্থায় আমার দলের শত শত নেতাকর্মী নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়েছে। খোদ বিএনপি কর্মীদের কেউ কেউ আজিজের কাছের লোক সেজে নিপীড়ন থেকে বাঁচার চেষ্টাও করেছেন।’
বিএনপি নেতাকর্মীদের পাশাপাশি কেশবপুর বাজারের বহু মানুষ আমার দেশকে তাদের ওপর জুলুমের বর্ণনা দেন। জানান, আজিজের হাতুড়ি বাহিনীকে চাঁদা না দিয়ে কেউ এলাকায় ব্যবসা করতে পারেনি। চাঁদা দিতে অস্বীকার করলে তার ওপর নেমে আসত নির্যাতনের স্টিম রোলার। ব্যবসায়ীরা মামলা করতে সাহস পেতেন না। সাহস করে কেউ এগিয়ে গেলেও পুলিশ মামলা নিত না।
ফ্যাসিবাদ সরকারের পতনের সঙ্গে সঙ্গে গা ঢাকা দিয়েছেন আজিজুল ইসলাম। সেকারণে অভিযোগের ব্যাপারে তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
তবে আজিজের হাতুড়ি বাহিনীর নিপীড়নের কথা অকপটে স্বীকার করেন কেশবপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গাজী গোলাম মোস্তফা। এই নেতা আমার দেশকে বলেন, ‘হাতুড়ি বাহিনীর ভয়ে বাজারের ব্যবসায়ীরা দোকান খুলতে পারত না। দরকারি কাজে কেশবপুর বাজারে আসতে পারত না মানুষ। উপজেলা ছাত্রলীগের শেষ সারির যুগ্ম আহ্বায়ক আজিজের বাহিনীর দখলে ছিল আওয়ামী লীগের উপজেলা কার্যালয়ও। দলীয় সভা বা অন্য কোনো কাজে আওয়ামী লীগ অফিসে গিয়ে আমাদের মতো সিনিয়র নেতাদেরও তটস্থ থাকতে হতো- সন্ত্রাসী বাহিনী কখন কাকে অপদস্থ করে বসে। বিশেষ করে নারী কর্মীরা দলীয় কার্যালয়েও নিরাপদ বোধ করত না।’
আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের ভাষ্য, ‘এমপি হওয়ার আগে আজিজ প্রকাশ্যে হাতুড়ি বাহিনীর নেতৃত্ব দিত। এমপি হওয়ার পর সে নেপথ্যে থেকে বাহিনী চালাত।’
আজিজের সন্ত্রাসী কার্যকলাপের বহু অভিযোগ ছিল তৎকালীন জেলা পুলিশের কাছে। আজিজকে বেশ কয়েকবার তারা ধরেও এনেছেন নানা অভিযোগে। যেহেতু প্রভাবশালী রাজনীতিকদের ছত্রছায়া ছিল, তাই পুলিশ তাকে আটকে রাখতে পারত না। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের সময় প্রার্থী হিসেবে আজিজুল ইসলাম নির্বাচন কমিশনে যে হলফনামা দেন, সেখানে তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইনে ছয়টি মামলার তথ্য রয়েছে। এর মধ্যে পাঁচটি মামলা চলমান।
থ্রিহুইলারে চেপে জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে যোগ দিতে যাওয়া ‘গরিব’ আজিজুল ইসলাম ইসিতে দেওয়া হলফনামায় কৃষি থেকে তার বার্ষিক আয় দেড় লাখ এবং ব্যবসা থেকে ১৫ লাখ টাকা দেখিয়েছেন।
তবে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গাজী গোলাম মোস্তফা বলছেন, ‘এমপি হওয়ার দুই দিনের মধ্যে আজিজ কমপক্ষে ৫০ লাখ টাকা কামিয়েছেন। নির্যাতন থেকে বাঁচতে ব্যবসায়ীসহ অন্যরা নগদ টাকা ও দামি উপহার সামগ্রী নিয়ে হাজির হন তার কাছে। এরপর সাত মাস এমপি থাকাকালে কত টাকা কামিয়েছেন সেই হিসাব আমার জানা নেই।
সূত্র: আমার দেশ
No comments:
Post a Comment