BDC CRIME NEWS24
ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফের শত কোটি টাকার বাড়িবিলাস:
(ইতালি থেকে আনা মার্বেল পাথরে গড়েন সমাধিসৌধ)
প্রকাশ: ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৩:১৯
ফরিদপুরের সাবেক এমপি ও মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন মাত্র ১০ বছরে প্রভাব-প্রতিপত্তি খাটিয়ে গড়ে তোলেন অঢেল সম্পদ। দুর্নীতি ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার সম্পদ অর্জন করেছেন। তার অনুসারীরাও দুর্নীতি আর লুটপাটের মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচারের ঘটনায় অভিযুক্ত। বহুল আলোচিত দুই হাজার কোটি টাকার মানি লন্ডারিংয়ের মামলায় যাদের অনেকেই এখন জেলে। দুর্নীতির মহোৎসবের কেন্দ্রে থেকেও ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে তিনি আইনের হাত থেকে বেঁচে যান এবং দেশ ছেড়ে আশ্রয় নেন বিদেশে মেয়ের কাছে। একসময়ের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী খন্দকার মোশাররফের বাংলো প্যাটার্নের তিনটি জৌলশপূর্ণ বাড়ি রয়েছে ফরিদপুরে, যা এ অঞ্চলের সবচেয়ে বিলাসবহুল ও আকর্ষণীয়। এই তিনটি বাড়ির বর্তমান বাজারমূল্য ১০০ কোটি টাকারও বেশি। এক সময় ক্ষমতার কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত এই বাসভবনগুলো এখন খাঁ খাঁ বিরাণভূমি।
ফরিদপুর-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন ২০০৯ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারের তিন মেয়াদে দলের টিকিটে এমপি হন। প্রথমবার শ্রমমন্ত্রী, পরেরবার প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী এবং সর্বশেষ স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি ২০১৪ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিতদের অন্যতম ছিলেন আর ২০১৮ সালের মিডনাইট ইলেকশনেও এমপি হন।
মোশাররফপুত্র খন্দকার মাশরুর হোসেন মিতু সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের সাবেক স্বামী। যিনি দীর্ঘদিন নিরুদ্দেশ রয়েছেন। শেখ পরিবারের ক্ষমতার বলয়ে ঢুকে এলজিইডি, বিআরটিএ, সড়ক বিভাগসহ বিভিন্ন সরকারি বিভাগের ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ, আত্মীয়-স্বজনদের মাধ্যমে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে অনিয়মের মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ এই খন্দকার পরিবারের বিরুদ্ধে।
২০২০ সালের ২৬ জুন ঢাকার কাফরুল থানায় খন্দকার মোশাররফের ভাই খন্দকার বাবরসহ মোশাররফ অনুসারীদের বিরুদ্ধে দুই হাজার কোটি টাকা পাচারের একটি মামলা করে সিআইডি। তার আগে ৬ জুন কথিত এক শুদ্ধি অভিযানে গ্রেফতার হয় খন্দকার মোশাররফের একের পর এক আস্থাভাজনেরা। যাদের আশ্রয় প্রশ্রয় ও অবৈধ টাকা উপার্জনের মূল অবলম্বন ছিলেন মোশাররফ। ওই মামলায় খন্দকার মোশাররফের ভাই বাবরকে মানি লন্ডারিংয়ের মাস্টার মাইন্ড হিসেবে আখ্যায়িত করেন বিচারিক আদালত। ২০০৯ সালের মাঝামাঝি থেকে ফরিদপুরে ভাইয়ের ছায়া হিসেবে আবির্ভূত হন খন্দকার মোহতেশাম হোসেন। তিনি খন্দকার মোশাররফের অলিখিত প্রতিনিধি হিসেবে ফরিদপুরের যাবতীয় কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করেন।
এ দিকে মামলায় গ্রেফতার এড়াতে খন্দকার মোশাররফসহ অনেকে গাঢাকা দিয়ে পালিয়ে বাঁচেন। হত্যাসহ অসংখ্য মামলায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতাদের কারাগারে ঢোকানো হয়। মানি লন্ডারিংয়ের মামলায় ছোট ভাই খন্দকার বাবরকে আসামি করা হয়। তবে আইনের জাল থেকে বেরিয়ে যেতে সক্ষম হন মোশাররফ। যাদের দ্বারা তৈরি হেলমেট ও হাতুড়ি, হেলমেট বাহিনীর হাতে বিএনপি নেতারাই শুধু নন, আওয়ামী লীগের অনেকেও নির্যাতনের শিকার হন। অবশ্য ৫ আগস্টে হাসিনার পতনের পর সম্প্রতি ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুদক।
ফরিদপুর শহরের বদরপুরে, কমলাপুরে ও ডিক্রিরচরে সরকারি খাস ও ব্যক্তিমালিকানার একের পর এক জমি দখল করে বিলাসবহুল এই তিনটি বাড়ি ছাড়াও মোশাররফের রয়েছে পৈতৃকভিটার আরো দু’টি বাড়ি। এ ছাড়া ঢাকার গুলশানেও তার বাড়ি রয়েছে। ফরিদপুরের ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের পাশে শহরের প্রবেশমুখে বদরপুরে তিনি তৈরি করেছেন ‘আফসানা মঞ্জিল’ নামের বিলাসবহুল বাড়ি। বাড়িটিতে পাশাপাশি বাংলো প্যাটার্নের তিনটি ভবনজুড়ে বিশাল প্রশস্তের একটি বাসভবন গড়ে তোলা হয়েছে। ইতালিয়ান মার্বেল পাথরে এই বাড়িতেই তৈরি করা হয়েছে একটি সমাধিসৌধ। সেই সমাধিসৌধে যদিও এ পর্যন্ত কাউকে দাফন করা হয়নি।
গাছগাছালিতে ঢেকে থাকা আফসানা মঞ্জিলের প্রকৃত রূপ বাইরে থেকে দেখে বোঝার জো নেই। বড় গেট মাড়িয়ে পিচঢালা পথ পেরিয়ে তবেই দেখা মিলে বাংলো প্যাটার্নের এই দৃষ্টিনন্দন বাড়িটির। এই অঞ্চলে এমন বিলাসী বাড়ি আরেকটা খুঁজে পাওয়া যাবে না আর। বাড়ির সামনের উঠোনে সরকারি প্রটোকল নেয়ার জন্য গার্ড অব অর্নার নেয়ার জন্য তৈরি পতাকার স্ট্যান্ডসম্বলিত বেদি করা হয়েছে। তারপরে বড় দীঘি আকৃতির পুকুরের পরে একটি চিড়িয়াখানা। তার এক পাশে এই সমাধিসৌধ। উত্তর-পূর্বে গরুর খামার। আর তার পেছনে ফসলি ক্ষেত। প্রায় এক বর্গকিলোমিটারজুড়ে তার এই জৌলশপূর্ণ বাড়ি এখন তার দম্ভের নীরব সাক্ষী, যা একসময় ছিল মাত্র দুই বিঘার মতো জমিজুড়ে। বাকি জমি তিনি জোর করে কব্জায় নেন বলে অভিযোগ।
এ ছাড়া সদর উপজেপলার ডিক্রিরচরে নামে-বেনামে কয়েক শ’ বিঘা সম্পত্তির ওপর বিস্তীর্ণ জমিজুড়ে রয়েছে খন্দকার মোশাররফের আরেকটি বাংলো বাড়ি। যেটি স্থানীয়দের কাছে পরিচিত ছিল ‘রংমহল’ হিসেবে। দেশ বিদেশ থেকে শিল্পী এনে বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। বাড়িটিতে যাওয়ার জন্য চরের বুকে এলজিইডির মাধ্যমে রাস্তাঘাট এমনকি সাদিপুরের ভূঁইয়াবাড়ি ঘাটে পদ্মা নদীতে একটি সেতুও নির্মাণের জন্য কয়েক শ’ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছিল।
শহরের দক্ষিণ কালিবাড়িতে রাজেন্দ্র কলেজ সংলগ্ন পৈতৃক বাড়ির পাশে প্রভাব খাটিয়ে তিনি অরুণ কুমার গুহ নামে এক হিন্দু ব্যক্তির দ্বিতল ভবনসহ তিন একর জমি কব্জা করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ‘দয়াময় ভবন’ নামে বাড়িটি নতুন করে সংস্কারের পর নাম রাখা হয়েছে ‘নুরুল ভিলা’। যা তার পিতা খন্দকার নুরুল হোসেন নুরু মিয়ার নামে। যাকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় শান্তি কমিটির সদস্য ছিলেন বলে রাজাকার আখ্যা দেয়া হয়ে। এই বাংলো বাড়িটির মূল্য বর্তমান বাজারে প্রায় ৮০ কোটি টাকার ওপরে বলে জানা গেছে। যদিও খন্দকার মোশাররফ বাড়িটির কাজ শেষ করে ভবনে যেতে পারেননি। আফসানা মঞ্জিলের মতো এই নুরুল ভিলার সামনের গেট এখন তালাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে।
শহরের টেপাখোলার বাসিন্দা রাজিবুজ্জামান রাজিব বলেন, খন্দকার মোশাররফ হোসেনের প্রভাব ও ক্ষমতাকে খাটিয়েই তার অনুসারীরা হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করেছে। তিনিও সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। হেলমেট বাহিনী তৈরি করে তিনি অসহায় মানুষের সহায়সম্পদ কেড়ে নিতেন। তার ভাইকে তিনি উপজেলা চেয়ারম্যানের চেয়ারে বসিয়েছিলেন। যার নেতৃত্বে দুর্নীতির মহোৎসব চালানো হয়। অথচ তিনিই এখনো আইনের চোখ ফাঁকি দিয়ে দিব্বি আছেন। তার অনুসারীরা এখনো প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ায়, মানুষজনকে হুমকি-ধমকি দেয়।
সম্প্রতি আফসানা মঞ্জিলের পেছনে বাউন্ডারি তুলে জমি ঘেরার কাজ শুরু হলে স্থানীয়দের সাথে বিরোধ বাধে। সেখানে লাইট হাইজ এজি চার্চ নামে একটি প্রতিষ্ঠানসহ অন্যান্য বাড়ি মালিকদের যাতায়াতের রাস্তা আটকে দেয়ার অভিযোগ করেন তারা। বদরপুরের বাসিন্দা স্যামুয়েল বাড়ৈ নামে একজন ভুক্তভোগী জানান, জমি দখলের জন্য একটি বিশেষ বাহিনী গড়ে তুলেন খন্দকার মোশাররফ। এরা নিরীহ প্রতিবেশীদের ওপরে নির্মম নির্যাতন করে জোর করে জায়গাজমি লিখে নিতো। জমি মালিকদের অনবরত বাড়ি ছেড়ে দিতে দিনেরাতে এসে হুমকি দিতো। কখনো হামলা চালিয়ে বাড়িঘর এমনকি মানুষদের কুপিয়ে যেত। যারা লিখে দিতে চাইত না, তাদেরটা জোর করেই লিখে নিতেন তিনি। আবার না লিখে দিলে জোর করেই অন্যের জমি অবৈধভাবে দখল করে নিতেন। এই বিশেষ বাহিনীর একটি বড় ভূমিকা ছিল খন্দকার মোশাররফের বাড়ি তৈরির বিলাসিতা বাস্তবায়নে।
জেলা খ্রিষ্টান অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক উজ্জ্বল ঘোষ বলেন, বাড়ির পুকুর ঘাটলায় ডেকে নিয়ে জমি লিখে দিতে হতো মোশাররফকে। আমাদের একটি চার্চের জমিও তিনি লিখে নিতে প্রচুর চাপ দিয়েছিলেন। কিন্তু আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ রেখে জমিটি রক্ষা করতে পেরেছি। অনেকেই তা পারেননি। রুস্তম শেখ নামে এক ব্যক্তির প্রায় দেড় একর জমি লিখে নেয়ার পর সেই শোকে লোকটি মারাই যায়। জেমস বৈদ্য নামে আরেক ব্যক্তি বলেন, তাদের ৪২টি পরিবারের দেড় একর জমি লিখে নিতে রামদা নিয়ে হামলা করে সন্ত্রাসী বাহিনী। তিনি ও তার স্ত্রী এ ঘটনার পর স্ট্রোক করে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। প্রশান্ত কুমার রায় নামে এক ব্যক্তি বলেন, তার তিন শতাংশ জমি জোর করে দখল করে গরুর খামার বানিয়ে রেখেছেন সাবেক এই মন্ত্রী।
এসব ব্যাপারে খন্দকার মোশাররফ হোসেন বা তার পরিবারের বক্তব্য জানতে তাদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তারা কেউ দেশে না থাকায় বক্তব্য জানা যায়নি। বদরপুরের বাড়িতে যেয়ে কেয়ারটেকার বিল্লালের কাছে তাদের সাথে যোগাযোগের জন্য ফোন নম্বর চাইলে তিনি যোগাযোগ করে জানাবেন বললেও পরে আর তা দেননি।
এরপর খন্দকার মোশাররফের আস্থাভাজন একজন নারী প্রতিনিধির সাথে কথা হলে তিনি তার মোবাইল থেকে কথা বলিয়ে দেন মোশাররফের জামাতা সাবেক এমপি কায়েদ-ই-মিল্লাতের সাথে। এ সময় কায়েদ-ই-মিল্লাত এই প্রতিবেদকের কাছে দাবি করেন, ফরিদপুরে তার শ্বশুর খন্দকার মোশাররফ হোসেনের এসব সম্পত্তির সবই বৈধ কাগজপত্র রয়েছে। কারো জায়গাজমি দখল করে নেননি তারা। আর যেই রাস্তা দেয়াল তুলে আটকে দেয়া হয়েছে সেটিও তার শ্বশুরের মালিকানাধীন। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, এখন আমাদের ক্ষমতা নেই, ওরা তাই ক্ষমতা দেখাচ্ছে। যদি কোনোদিন সময় আসে আমরাও জবাব দিবো।
সূত্র: ডেইলি নয়া দিগন্ত
No comments:
Post a Comment