BDC CRIME NEWS24
গুলিতে থমকে গেল দেড় হাজার কর্মক্ষম জীবন:
প্রকাশ: ০৩ আগস্ট ২০২৫
মোটরসাইকেলে রাইড শেয়ারিং করতেন হাসিবুর রহমান শান্ত। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের খবরে গত ৫ আগস্ট বিজয় মিছিলে যোগ দেন তিনি। রাজধানীর মেরুল বাড্ডা থানার সামনে এলে পুলিশের গুলি হাসিবুরের মাথার পেছন দিয়ে ঢুকে কপাল ফুঁড়ে বের হয়ে যায়। চিকিৎসকদের চেষ্টায় মৃত্যুর শঙ্কা কাটলেও আগের সব স্মৃতি হারিয়ে ফেলেন তিনি। অন্যের সহযোগিতা ছাড়া কাজ করতে পারেন না। সংকটে পরিবার ঢাকা ছেড়ে গ্রামের বাড়ি বরিশাল চলে গেছে। সংসারে অর্থকষ্ট থাকলেও মেলেনি সরকারি সহায়তা।
গাজীপুরের মাওনার একটি পোশাক কারখানায় কাজ করতেন মো. শামীম ও তাঁর স্ত্রী রাজিয়া বেগম। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে পুলিশের গুলিতে শামীম আহত হওয়ার পর থেকে রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (নিটোর) কাটছে তাদের জীবন। গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের নান্দাইল হলেও চিকিৎসার জন্য এখন ঢাকাতেই দিন কাটে পরিবারটির। বিছানায় শুয়ে থাকা স্বামীকে দেখিয়ে রাজিয়া বলেন, ‘বিছানা ছেড়ে উঠতে পারছে না, আজ ১১ মাস হয়ে গেল। উনাকে একা রেখে কিছুই করা যায় না। আমিও চাকরি করতে পারছি না।’
গণঅভ্যুত্থানে হাসিব ও শামীমের মতো ১ হাজার ৪৬৬ জুলাইযোদ্ধার গুলিতে স্থায়ী অক্ষমতা বা শারীরিক প্রতিবন্ধিতা তৈরি হয়েছে। এদের ভবিষ্যৎ নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। সরকারের পক্ষ থেকে আহতদের পুনর্বাসনের কথা বারবার বলা হলেও এক বছরেও দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমের (এমআইএস) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, আহত ১৩ হাজার ৮১১ জন। তাদের তথ্য পর্যালোচনা করে ১ হাজার ৪৬৬ জনকে পাওয়া গেছে, যারা স্থায়ীভাবে অক্ষম। এর মধ্যে অতি গুরুতর আহত ১৩৪ জন, গুরুতর আহত ৮০০ জন। ৪৯৩ জন এক চোখের দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন আর দুই চোখ হারিয়েছেন ৩৯ জন। এদের মধ্যে এক পা কেটে ফেলতে হয়েছে ২১ জনের। এক হাত কেটে ফেলতে হয়েছে সাতজনের। এছাড়া মোটামুটি আহত তিন হাজার এবং সামান্য আহত সাত হাজার জন।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, যারা পুরোপুরি দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন বা শারীরিক প্রতিবন্ধী হয়ে গেছেন তাদের অতি গুরুতর (এ শ্রেণি) হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। তারা সারা জীবন অন্যের সাহায্য ছাড়া চলতে পারবেন না। সরকার তাদের ভাতা দেবে। গুরুতর আহত ব্যক্তিরা (বি শ্রেণি) নিজে কাজ করে চলতে পারবেন। তাদের শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করবে সরকার। তাদের কেউ কাজের উপযুক্ত হয়ে না উঠলে তাকেও ভাতা দেওয়া হবে। বাকি আহতদেরও প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করবে সরকার।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব সাইদুর রহমান বলেন, গণঅভ্যুত্থানে শহীদের তালিকা প্রস্তুত করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। সেই তালিকা অনুসারে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে। মাসিক ভাতা চালু হচ্ছে এ মাসেই। আহতের পুনর্বাসনের জন্য তথ্য সংগ্রহের কাজ চলমান রয়েছে। দ্রুত পুনর্বাসনের কাজ শুরু হবে।
এখনও চিকিৎসাধীন শতাধিক আহত
গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ৯২ জন আহত ব্যক্তি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তাদের মধ্যে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু হাসপাতাল) ১০ জন, বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএমইউ) ৩২ জন, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) ২২ জন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৯ জন রয়েছেন। এছাড়া সাভারের সিআরপিতে আছেন ১৯ জন।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, উন্নত চিকিৎসার জন্য এ পর্যন্ত ৭৫ জনকে বিদেশে পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে সিঙ্গাপুরে ১১ জন, থাইল্যান্ডে ৫৬ জন, তুরস্কে সাতজন ও রাশিয়ায় একজনকে পাঠানো হয়েছে। চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরেছেন ২৯ জন। এখনও থাইল্যান্ডে ৩৯ ও তুরস্কে সাতজন চিকিৎসার জন্য আছেন। এ পর্যন্ত বিদেশে চিকিৎসায় খরচ হয়েছে ৭৮ কোটি ৫২ লাখ ২৬ হাজার ৯১০ টাকা। আর আহত ব্যক্তিদের মধ্যে যারা দেশে চিকিৎসা নিয়েছেন বা নিচ্ছেন, তাদের খরচ সরকার বহন করেছে।
জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতালের পরিচালক মো. আবুল কেনান বলেন, আন্দোলন শুরু থেকে এ পর্যন্ত ৯০২ জনকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৬০৬ জন আহত রোগী ভর্তি ছিলেন। এখনও সেখানে ১০ জন ভর্তি আছেন। তাদের একাধিক অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে।
তিনি বলেন, এখন প্রতিদিন অনেক জুলাই আহত বহির্বিভাগে চিকিৎসার জন্য আসেন। তারা ভর্তি থাকতে চান, আমরা তাদের বুঝিয়ে চিকিৎসা দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেই। কারণ এ রকম একটা জাতীয় প্রতিষ্ঠানকে একান্ত প্রয়োজন ছাড়া দীর্ঘমেয়াদি অকুপাই করা যুক্তিসঙ্গত নয়।
সহায়তার তহবিলে অর্থ সংকট
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ৯১ শতাংশ শহীদ পরিবার জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে আংশিক আর্থিক সহায়তা পেয়েছে। আর আহত ব্যক্তিদের মধ্যে আংশিক সহায়তা পেয়েছে ৩৯.৩৬ শতাংশ। এর মধ্যে সহায়তার তহবিলে অর্থ সংকট দেখা দিয়েছে বলে জানিয়েছেন জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) কামাল আকবর।
তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের গেজেটভুক্ত জুলাই শহীদ পরিবার ৮৩৪টি। গেজেটভুক্ত আহত ১২ হাজার ৪৩ জন। জুলাই ফাউন্ডেশনের ৩০ জুলাইয়ের সর্বশেষ তথ্য বলছে, এরই মধ্যে প্রথম ধাপে আর্থিক সহায়তা পেয়েছে ৬ হাজার ১৯৬ জন আহত ও ৭৫৯ জন শহীদ পরিবার। এখনও আট হাজার পরিবার সরকার থেকে আর্থিক সহায়তা পায়নি।
তিনি আরও বলেন, আমাদের তহবিলে তেমন টাকা নেই। বাকি পরিবারের আর্থিক সহায়তা দিতে ২৩৩ কোটি টাকার প্রয়োজন। এ জন্য যারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ও এখনও চিকিৎসাধীন, তাদের টাকা দেওয়ার চেষ্টা করছি। কামাল আকবর জানান, প্রধান উপদেষ্টার তহবিল থেকে ১০০ কোটি, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ৫ কোটি, ব্যক্তিগত পর্যায়ে ৫ কোটিসহ সব মিলিয়ে মোট ১১৮ কোটি টাকা সহায়তা আসে। এর মধ্যে ১১০ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে।
সূত্র: সমকাল

No comments:
Post a Comment