BDC CRIME NEWS24
জেসিআইএলে অবৈধ নিয়োগ-
রহস্যজনক খুঁটির জোরে বহাল সিই শহীদুল:
প্রকাশ: ০৯ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম
চাকরিবিধি লঙ্ঘন করে ফ্যাসিস্টদের আমলে নিয়োগ পাওয়া ‘জনতা ক্যাপিটাল অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লি.র (জেসিআইএল) সিই (চিফ এক্সিকিউটিভ) শহীদুল হক বহাল তবিয়তে রয়েছেন। ফ্যাসিস্টের দোসর সালমান এফ রহমানের প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকো শেয়ার কারসাজির মাধ্যমে ৪৭৭ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনায় সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় জনতা ক্যাপিট্যাল ইনভেস্টমেন্টে। এটি ঘটে তার আমলেই। জনতা ব্যাংকের বোর্ডে শহীদুলের বিরুদ্ধে আসা অভিযোগ আমলে নিয়ে তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সেখানে নিয়ম লঙ্ঘন করে এ পদে নিয়োগের বিষয়টি ধরা পড়েছে। কিন্তু রহসজনক খুঁটির জোরে এখনো টিকে আছেন শহীদুল হক। তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।
সূত্রমতে, নিজের আত্মীয় বলে সিই নিয়োগ দিতে বিধিবিধান এবং নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির শর্ত তোয়াক্কা করেননি জনতা ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ড. এসএম মাহফুজুর রহমান। তিনি (মাহফুজুর) নিজেও সালমান এফ রহমানের প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকো এবং এস আলমকে ঋণের নামে একচেটিয়া লুটপাটের সুযোগ করে দিয়ে ব্যাংকের ভিত্তি পঙ্গু করে দিয়েছেন। ফলে বর্তমান পরিচালনা পর্ষদ ব্যাংকের কার্যক্রম টিকিয়ে রাখতে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে।
জানতে চাইলে জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মজিবুর রহমান যুগান্তরকে জানান, জেসিআইএলের সিইর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তার বিরুদ্ধে নিয়োগ বিধি লঙ্ঘনের বিষয়টি ব্যাংক কর্তৃপক্ষ আমলে নিয়েছে। এ নিয়ে ব্যাংকের বোর্ড সভায় আলোচনা হয়েছে। এ বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। তদন্ত রিপোর্ট পেলেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, শহীদুলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে এর আগে বোর্ড সভায় একটি সিদ্ধান্ত হয়। সেটি হলো নিজ দায়িত্বে সংশ্লিষ্ট পদ থেকে সিই শহীদুল হক পদত্যাগ করবেন। ব্যাংকের হিউম্যান রিসোর্স (এইচআর) বিভাগ থেকে এ বার্তা শহীদুল হককে জানানোর কথা। পরবর্তী আরেক বোর্ড সভায় পূর্ণাঙ্গ তদন্তের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, বোর্ডের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অদৃশ্য কোনো প্রভাব কাজ করছে কিনা সেটি দেখতে হবে। যদিও বর্তমান পরিচালনা পর্ষদ একমত এ ধরনের অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে শহীদুল হক শনিবার যুগান্তরকে জানান, তাকে পদত্যাগ করতে হবে এমন কোনো বার্তা অফিশিয়ালি পাননি, কেউ তাকে অবহিত করেনি।
জনতা ব্যাংকের সাবসিডিয়ারি কোম্পানি হচ্ছে জনতা ক্যাপিটাল অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লি.। এ প্রতিষ্ঠানে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়। জেসিআইএলের সিই পদে নিয়োগের বিধি লঙ্ঘনের বিষয়টি যুগান্তরের অনুসন্ধানে প্রথমে বেরিয়ে আসে ২৪ নভেম্বর। ইতোমধ্যে প্রায় ৩ মাস কেটেছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, এই ৩ মাসে জনতা ক্যাপিটাল ইনভেস্টমেন্ট খুব বেশি মুনাফা না করলেও জালিয়াতির মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত শহীদুলের পেছনে বেতন-ভাতা মাসে মাসে গুনতে হচ্ছে।
জানা যায়, জনতা ব্যাংকের ওই বছরের ৬৩৭তম পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জেসিআইএলের সিই নিয়োগের জন্য শহীদুল হকসহ তিন প্রার্থীকে সাক্ষাৎকারের জন্য ডাকে তৎকালীন নিয়োগসংক্রান্ত কমিটি। ওই কমিটির সভাপতি ছিলেন ব্যাংকটির তৎকালীন চেয়ারম্যান ড. এসএম মাহফুজুর রহমান। কমিটির সদস্য ছিলেন ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য অজিত কুমার পাল (পরিচালক), অধ্যাপক স্বপন কুমার বালা (প্রাক্তন ব্যবস্থাপনা পরিচালক) ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ, বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন প্রতিনিধি এবং জনতা ব্যাংকের সাবেক এমডি আব্দুস ছালাম আজাদ ছিলেন আহ্বায়ক। আরও জানা গেছে, পর্ষদের নিয়োগসংক্রান্ত সিদ্ধান্তের নথি কমিটির বৈঠকে উত্থাপন করা হয়।
সেখানে প্রথম সুপারিশ ছিল মোহাম্মদ আলী নামের এক প্রার্থী। তার প্রসঙ্গে বলা হয় ‘বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী পেশাগত যোগ্যতা, বয়স ও অভিজ্ঞতা যথাযথ রয়েছে। মার্চেন্ট ব্যাংকের অভিজ্ঞতাও যথাযথ রয়েছে। তবে বিকম’র (সম্মান) স্থলে বিকম (পাশ)। দ্বিতীয় প্রার্থী গোলাম কিবরিয়া প্রসঙ্গে সুপারিশে উল্লেখ করা হয় ‘বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী-পেশাগত যোগ্যতা, বয়স ও অভিজ্ঞতা যথাযথ রয়েছে। মার্চেন্ট ব্যাংকের অভিজ্ঞতাও যথাযথ রয়েছে। তবে স্নাতকত্তোর ডিগ্রি নেই এবং বিকম’র (সম্মান) স্থলে বিকম (পাশ)।
আর সর্বশেষ সুপারিশ করা হয়েছিল শহীদুল হককে। সেখানে বলা হয়, ‘বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী পেশাগত যোগ্যতা যথাযথ রয়েছে। মার্চেন্ট ব্যাংকের অভিজ্ঞতাও রয়েছে। তবে বয়স কম ও মোট ১৫ বছরের অভিজ্ঞতার ঘাটতি রয়েছে। বিকম’র (সম্মান) স্থলে বিকম (পাশ) এবং বিকম (পাশ) তৃতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ।
সংশ্লিষ্টরা জানান, জনতা ব্যাংকের বিধান অনুযায়ী তিনজন প্রার্থীর মধ্যে কেউ নিয়োগের যোগ্য নন। আবার তিনজন প্রার্থীর মধ্যে তুলনামূলক কম যোগ্য প্রার্থী ছিলেন বর্তমান সিই শহীদুল হক। কিন্তু সব বিধান ভেঙে সিই পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল শহীদুল হককে।
তবে নিজের যোগ্যতা ও শিক্ষাগত যোগ্যতা কম-এমন প্রশ্ন অস্বীকার করেছেন জনতা ক্যাপিটাল অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের সিই শহীদুল হক। তিনি যুগান্তরকে বলেন, ‘অভিযোগ সঠিক নয়। সব নিয়ম মেনেই আমার নিয়োগ হয়েছে। ইন্টারভিউ, স্কুটিং ও সব ধরনের বিধান অনুসরণ করেই সেটি হয়েছে। প্রয়োজনে অনুসন্ধান করে দেখতে পারে সরকার।’
তবে শর্ত ভেঙে রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি জেসিআইএলের সিই নিয়োগে অনিয়মের বিষয়টি তদন্ত করছে জনতা ব্যাংকের হিউম্যান রিসোর্স ডিপার্টমেন্ট। অনিয়মের মাধ্যমে নিয়োগের বিষয়টি এর আগে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ এবং জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যানের কাছে লিখিত অভিযোগ জমা পড়ে।
জানা গেছে, শহীদুল হককে ২০২০ সালের শেষদিকে নিয়োগ দেওয়া হয় জনতা ক্যাপিটাল ইনভেস্ট লি.র সিই হিসাবে। এর পরের ২ বছর অর্থাৎ ২০২১ এবং ২০২২ সালে বেক্সিমকো শেয়ার কারসাজির মাধ্যমে ৪৭৭ কোটি মুনাফা তুলে নেওয়ার ঘটনা ঘটে। এক্ষেত্রে জনতা ক্যাপিটাল অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টকে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করে বেক্সিমকোর শেয়ার কারসাজির জন্য। সম্প্রতি এ ঘটনা উদ্ঘাটনের পর জড়িত চার ব্যক্তি ও পাঁচ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ৪২৮ কোটি টাকার বেশি জরিমানা করেছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।
তবে জনতা ব্যাংকের হিউম্যান রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট ডিপার্টমেন্টের জিএম (জেনারেল ম্যানেজার) আব্দুল মতিন যুগান্তরকে জানান, জনতা ব্যাংকের বিধিবিধানে স্বাভাবিক বা চুক্তিভিত্তিক যে কোনো নিয়োগের ক্ষেত্রে তৃতীয় শ্রেণির ডিগ্রিপ্রাপ্ত গ্রহণযোগ্য নয়।
সূত্রমতে, অর্থ উপদেষ্টার কাছে লিখিত অভিযোগপত্রে এ প্রসঙ্গে বলা হয়, তৎকালীন সিই হিসাবে শহীদুল হককে নিয়োগের জন্য গঠিত সাক্ষাৎকার কমিটির ৫ সদস্যের মধ্যে ২ জন এক্সটার্নাল সদস্যের যথেষ্ট বিরোধিতার পরেও ব্যাংকের তৎকালীন চেয়ারম্যান ও এমডি এ বিতর্কিত নিয়োগ সম্পন্ন করেন।
সূত্র: যুগান্তর
No comments:
Post a Comment