BDC CRIME NEWS24
রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে ভারতীয় দূতাবাসের লোক:
প্রকাশ : ১৬ জানুয়ারি ২০২৫, ১০: ৪৯
আওয়ামী সরকারের টানা তিন মেয়াদেই বিভিন্ন বাহিনীর যৌথ নির্যাতনের শিকার হন তরুণ আলেম মুফতি হারুন ইজহার। তিন দফায় গ্রেপ্তার হয়ে পাঁচ বছর জেলে কাটান তিনি। দফায় দফায় ৭০ দিনের রিমান্ডে নিয়ে নির্মম নির্যাতন করা হয় তার ওপর। রিমান্ডে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার পাশাপাশি জিজ্ঞাসাবাদে ছিলেন হিন্দু ধর্মাবলম্বী একজন সম্পাদক ও ভারতীয় দূতাবাসের কর্মকর্তা।
জেলখানায়ও ২৪ ঘণ্টা লকআপে রাখা হয় ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে। গ্রেপ্তার-রিমান্ড ছাড়াও অনানুষ্ঠানিকভাবে দফায় দফায় আটক ও জিজ্ঞাসাবাদের নামে হয়রানির শিকার হন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের এই যুগ্ম মহাসচিব। ফ্যাসিস্ট সরকারের জুলুমের শিকার হয় তার পরিবারও। স্ত্রী-সন্তানদের গ্রেপ্তারের হুমকিসহ নানা ভয়ভীতি দেখান আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার লোকরা।
খ্যাতিমান এই আলেম আমার দেশকে জানিয়েছেন তার ওপর আওয়ামী সরকারের বর্বরতার অংশবিশেষ। মুফতি হারুন ইজহার দেশের বিভিন্ন কওমি মাদরাসার পাশাপাশি লেখাপড়া করেছেন ভারতের দেওবন্দ ও পাকিস্তানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। চট্টগ্রামের জামিয়াতুল উলূম আল-ইসলামিয়া লালখান বাজার মাদরাসায় শিক্ষকতা ছাড়াও নিজে প্রতিষ্ঠা করেছেন একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
ওয়াজ-মাহফিলের পাশাপাশি হেফাজতে ইসলামের কর্মকাণ্ডে সক্রিয় থাকায় বিগত আওয়ামী সরকারের রোষানলে পড়েন তিনি। তার বিরুদ্ধে সরকারের সবচেয়ে বেশি ক্ষোভ ছিল তার ভারতবিরোধী অবস্থানের কারণে। এ জন্য গ্রেপ্তারের পর সরাসরি ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার লোকরা তাকে জিজ্ঞাসাবাদের নামে নির্যাতন করেছে বলে তার অভিযোগ।
আওয়ামী সরকারের সময়ে আলেম নির্যাতন প্রসঙ্গে লালখান বাজারের আল-জামিয়াতুল ইসলামিয়ার নির্বাহী পরিচালক মুফতি হারুন ইজহার আমার দেশকে বলেন, অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা যে, বাংলাদেশের সবচেয়ে জুলুমবাজ সরকার ছিলেন শেখ হাসিনা। একটানা ১৫ বছর শাসন করে গেছেন, এই দেড় দশকের পুরো সময়টাই ছিল নির্যাতনের বছর। ২০০৯ সাল থেকেই মূলত আলেম-ওলামাদের ওপর নির্যাতনের সূচনা হয়।
তিনি বলেন, আওয়ামী সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের নভেম্বরে আমি প্রথম গ্রেপ্তার হই। জুলুমবাজ ফ্যাসিস্ট সরকারের পুরো সময়টাই ভিকটিম আমি। আমার নামে কোনো অভিযোগ দিতে না পারায় ডিটেনশনে রাখা হয়েছিল আমাকে। চট্টগ্রামের নিজের বাড়ি থেকে ধরে বিশেষ ক্ষমতা আইনে তিন মাস আটকে রাখা হয়। পরে হাইকোর্ট থেকে জামিনে মুক্তি পাই। এরপরও চলাফেরার ওপর ছিল বিধিনিষেধ। নিরাপত্তাহীনতার কারণে ঘর থেকে বের হতে পারতাম না।
২০১৩ সালের অক্টোবরে দ্বিতীয়বারের মতো গ্রেপ্তার করা হয় তাকে। ২০১৬ সালের জুলাই পর্যন্ত তিন বছর জেলে ছিলেন তিনি। তৃতীয় পর্বে গ্রেপ্তার হন ২০২১ সালে। মোদির আগমনবিরোধী আন্দোলন ঘিরে উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে এক ডজন মিথ্যা মামলা দিয়ে বহু আলেম-ওলামার পাশাপাশি হারুন ইজহারকেও গ্রেপ্তার করা হয়। ২০২৩ সালের মে মাস পর্যন্ত কারাগারে ছিলেন তিনি।
তিন দফায় গ্রেপ্তার-নির্যাতন প্রসঙ্গে হারুন ইজহার বলেন, প্রথমবার গ্রেপ্তারের সময় ডিএমপি কমিশনার ছিলেন শহীদুল হক। তখন ডিবিপ্রধান ছিলেন মনিরুল। গ্রেপ্তারের পর তিন দিন গুম করে রাখা হয়েছিল তাকে। ওই সময় তাকে সরাসরি ক্রসফায়ারের হুমকি দেওয়া হয়। আর জিজ্ঞাসাবাদের সময় প্রথম আলোর নিউজ দেখিয়ে নির্যাতন করে।
তাকে জঙ্গি, লস্কর ই তৈয়বার সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগ এবং ভারতবিরোধিতার জন্য জিজ্ঞাসা করা হয়। এ সময় একজন এডিসি বলেন, ইসলাম এ দেশে চলবে না, ইসলাম চাইলে পাকিস্তান চলে যাও।
তিনি জানান, কোনো অভিযোগ প্রমাণ করতে না পারায় ৫৪ ধারায় জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয় তাকে। ১৫ দিনের মাথায় জামিন নিয়ে বের হন তিনি। কিন্তু ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের গেট থেকে আবার ধরে ফেলে পুলিশ। বিশেষ ক্ষমতা আইনে তাকে জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। প্রথমবার গ্রেপ্তারের পর তিনি দুই দফায় পাঁচ দিনের রিমান্ডে ছিলেন। কোনো কিছু প্রমাণ করতে না পারায় আদালত সংশ্লিষ্টদের ভর্ৎসনাও করেছিলেন।
হারুন ইজহার জানান, তাকে মূল নির্যাতন শুরু করে ২০১৩ সালে গ্রেপ্তারের পর। সে সময় হেফাজতের চট্টগ্রাম কো-অর্ডিনেটর ছিলেন তিনি। শাপলা চত্বরের ঘটনার দিন তিনি চট্টগ্রামেই ছিলেন। অথচ এ ঘটনায় প্রায় দুই ডজন মামলা দেওয়া হয় তার বিরুদ্ধে।
পরে চট্টগ্রামের কিছু মামলায়ও তাকে যুক্ত করা হয়। সে সময় প্রত্যেকটা মামলায় প্রায় ১০ দিন করে রিমান্ড চাওয়া হয়। প্রথমে চার মামলায় এক নাগাড়ে ১৭ দিন রিমান্ডে ছিলেন তিনি। এরপর দফায় দফায় রিমান্ডে নেওয়া হয় হারুন ইজহারকে। প্রথমে চট্টগ্রামে রিমান্ডে নেওয়া হয়, সেখানে র্যাব-পুলিশ-এনএসআইসহ অন্য সংস্থা যৌথভাবে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে।
মুফতি হারুন ইজহার বলেন, চট্টগ্রামে রিমান্ডের সময় অফিসাররা সব হিন্দু ছিলেন। রিমান্ডে তার চোখা বাঁধা ছিল। এ সময় চেয়ার দিয়ে জোরে আঘাত করা হয়। র্যাবের একজন তাকে কিল মেরেছিল। কয়েকজন মহিলা হিন্দু অফিসার ছিলেন। এদের মধ্যে একজন ছিলেন অনন্দিতা রায়।
রিমান্ড শেষে তাকে আনা হয় ঢাকার ডিবিতে। তখন আবার আদালতে তুলে রিমান্ড চাওয়া হয়েছিল। পরে যতবারই তিনি জামিন পান, ততবারই তাকে জেলগেট থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। এভাবে তিনবার তাকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। জেলগেট থেকে শুধু আটক নয়, আবার গুম করে নির্যাতন করা হয়। ২০১৫ সালে এ ধরনের গুমের ৪৮ ঘণ্টা পর আদালতে হাজির করে পুলিশ। নতুন মামলা দিয়ে আবার রিমান্ড ও জেলে পাঠায়। এভাবে ২০১৩ সালে গ্রেপ্তার-পরবর্তী ৪৫ দিন রিমান্ডে নেয় তাকে।
সর্বশেষ ২০১৬ সালে হাইকোর্ট থেকে ‘নো অ্যারেস্ট, নো হ্যারেজ’ অর্ডার নিয়ে জেল থেকে বের হওয়ার পরও গ্রেপ্তার হন তিনি। তখন অর্ডারটি তার স্ত্রী দেখালে চট্টগ্রামের এসবিপ্রধান তা ছুড়ে ফেলে দেন। পরে আদালত অবমাননার মামলার হুমকি দিলে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তিনি জানান, রাজনৈতিক মামলায় আটক করলেও আলেম দেখলেই জঙ্গি হিসেবে আখ্যায়িত করে পুলিশ। সন্ত্রাসীর মতো আচরণ করা হতো তাদের সঙ্গে।
তৃতীয় দফায় ২০২১ সালে গ্রেপ্তারের পর ২৪ ঘণ্টা গুম রেখে আদালতে পাঠায় তাকে। সে সময় র্যাবের রিমান্ডের পর হাটহাজারী থানায় নিয়ে বর্বর নির্যাতন করা হয় তাকে। ক্রিকেট স্টাম্প দিয়ে তাকে পেটায়। একটি ঘটনায় বিভিন্ন সংস্থা তাকে রিমান্ডে নেয়। পরে চট্টগ্রাম থেকে পাঠানো হয় রাজশাহীতে। সেখানে জঙ্গি মামলায় একটি সংস্থা রিমান্ডে নেয়। পরে নেওয়া হয় ঢাকার সিটিটিসিতে। সেখানে ভারতীয় দূতাবাসের কর্মকর্তা ড. নিতিশ সেই জিজ্ঞাসাবাদে সরাসরি যুক্ত ছিলেন।
পিবিআইয়ের রিমান্ডে ভিন্ন ধরনের নির্যাতনের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, চার দিনের রিমান্ডে তারা এক মুহূর্তও ঘুমাতে দিত না। চেয়ারে বসিয়ে রাখত। একপর্যায়ে নামাজের সেজদার মতো করে ঘুমানোর চেষ্টা করতেন তিনি। তবে তারা টের পেলেই জাগিয়ে তুলত।
তিনি বলেন, রিমান্ডে সবচেয়ে বড় যে ঘটনা ঘটেছে, তা দেশের জন্য হুমকিস্বরূপ। কারণ স্বাধীন একটি দেশের সরকারি সংস্থা সিটিটিসির রিমান্ডে হিন্দু পূজা উদযাপন পরিষদ নেতা এবং কালবেলা সম্পাদক ও প্রকাশক সন্তোষ শর্মা দোভাষী ছিলেন এবং ভারতীয় দূতাবাসের এডুকেশন মিনিস্টার বা গোয়েন্দা ভাষায় স্টেশন ম্যানেজার বলা হয়, তিনি তাকে দীর্ঘ সময় হিন্দি ভাষায় জিজ্ঞাসাবাদ করেন। প্রথমে সন্তোষ শর্মা নিজেকে মানবাধিকার কর্মী এবং আরেকজনেক শ্রীলঙ্কা থেকে এসেছেন বলে পরিচয় করিয়ে দেন। তবে তিনি কথা বলছিলেন হিন্দি ভাষায়।
ভারতীয় দূতাবাসের সেই কর্মকর্তা চলে যাওয়ার সময় একটা কাগজ এবং একটা খাম দিয়ে যান। খামে সম্ভবত টাকা দিয়ে যান। তার মানে ভারতীয় দূতাবাসের সঙ্গে তাদের টাকা লেনদেন হতো। পরে রাতে যখন আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়, তখন দেখি সেই ভারতীয় কর্মকর্তার দেওয়া কাগজ দেখে প্রশ্ন করছিলেন। সে সময় ডিসি আব্দুল মান্নান, ডিসি ইমরান ও ডিসি আতিক ছিলেন। ওই রিমান্ডের সময় সিটিটিসিতে খাবারে বিষ খাওয়ানোর অভিযোগ করেন হারুন ইজহার।
তিনি বলেন, এখানে প্রথমত আওয়ামী লীগ। দ্বিতীয়ত, ভারতীয় বাহিনী এবং তৃতীয়ত, মিডিয়ার মাধ্যমে আলেমদের নির্যাতন করা হতো।
শুধু রিমান্ডে নির্যাতন নয়, জেলে পাঠানো হলেও গোয়েন্দা সংস্থার লোকরা চাপ সৃষ্টি করে আরেক ধরনের নির্যাতন করতেন। এই নির্যাতন ছিল দীর্ঘমেয়াদি। ২৪ ঘণ্টা লকআপে রেখে দিতেন। মাঝেমধ্যে বেড়ি পরিয়ে রাখতেন। সার্বক্ষণিক থাকত সিসি ক্যামেরা। আদালতে আনা-নেওয়ার সময় ডান্ডাবেড়ি, হ্যান্ডকাফ ও হেলমেট পরিয়ে অমানবিকভাবে নির্যাতন করা হতো। মাঝেমধ্যে হ্যান্ডকাফ পেছনদিকে পরানো হতো। এই জুলুমের সঙ্গে আওয়ামী লীগ, পুলিশ, জেল কর্তৃপক্ষ, আদালত, গোয়েন্দা সংস্থা এবং দেশবিরোধী মিডিয়া জড়িত ছিল।
এর আগে গ্রেপ্তারের পরপরই ভারতবিরোধিতার বিষয়ে পুলিশ ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি নেয়, তখন বলা হয়, এটা না দিলে আবার রিমান্ডে পাঠানো হবে এবং সব জেলায় ঘোরানো হবে। এরপর চট্টগ্রামে আদালতের বিচারক চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কামরুননাহার রুমি একইভাবে বলেন, পুলিশ যা লিখে দিয়েছে, তা বলেন, নইলে আবার রিমান্ডে পাঠিয়ে দেব। ওই আদালতের খাসরুমে ডিজিএফআইয়ের লোকও বসা ছিল।
সূত্র: আমার দেশ
No comments:
Post a Comment