Friday, November 1, 2024

রেলের লাগেজ ভ্যানের নামে ৩৬০ কোটি টাকার শ্রাদ্ধ।

রেলের লাগেজ ভ্যানের নামে ৩৬০ কোটি টাকার শ্রাদ্ধ:

প্রকাশ: ০১ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

৩৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে পণ্য পরিবহনের উদ্দেশ্যে ১২৫টি লাগেজ ভ্যান কিনেছিল বাংলাদেশ রেলওয়ে। কারিগরি সহায়তা প্রকল্পের বিপরীতে তৎকালে করা সমীক্ষায় বলা হয়েছিল, লাগেজ ভ্যান ও ওয়াগন কিনলে পণ্য পরিবহনের সক্ষমতা ও আয় বাড়বে। বাস্তবের চিত্র উল্টো। এখন এগুলো রেলের বোঝা হয়ে পড়েছে। শুধু তাই নয়। এর বিপরীতে যে ঋণ নেওয়া হয়েছিল, সেই ঋণও সুদসহ পরিশোধের দায় নিতে হচ্ছে সরকারকে।

প্রকল্পটি অনুমোদনের সময় রেলের মহাপরিচালক (ডিজি) পদে ছিলেন আমজাদ হোসেন। দরপত্র এবং ক্রয়চুক্তির সময়ে ডিজি ছিলেন শামসুজ্জামান। তারা এখন স্বাভাবিক অবসরে। এ ছাড়া সরকারের তরফে দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীরাও এখন আর দায়িত্বে নেই। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও আছেন একরকম ধরাছোঁয়ার বাইরে। সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্যমতে, এসব লাগেজ ভ্যান বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়ার চিন্তা করছে কর্তৃপক্ষ।

গত বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর লাগেজ ভ্যানের উদ্বোধন করা হয়। লাগেজ ভ্যানে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে প্রতি কেজি পণ্যের ভাড়া ২ টাকা ৩৬ পয়সা। অন্যান্য রুটে ভাড়া ১ টাকা ৬৮ পয়সা থেকে ২ টাকা ৯৪ পয়সা। তৎকালীন রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম

সুজন উদ্বোধনের সময় দাবি করেছিলেন, সরকারের কৃষিবান্ধব নীতিতে ভ্যান কেনা হয়েছে। এর মাধ্যমে চাহিদার ভিত্তিতে শাক-সবজি, ফুল-ফল, মাছ-মাংস, দুধ-ডিম, ওষুধ পরিবহন করে আয় বাড়াবে রেল।

রেল কর্মকর্তারা এখন বলছেন, কারিগরি সহায়তা প্রকল্পে সমীক্ষা হলেও কৃষক কিংবা ব্যবসায়ীদের চাহিদা, বাজার প্রভৃতি যাচাই করা হয়নি এসব ভ্যান কেনার সময়। সেই সময়ের শীর্ষ কর্মকর্তা ও মন্ত্রীর দপ্তরের আগ্রহে কেনা হয়েছিল। তারা ‘কমিশন’ খেয়ে রেলের ঘাড়ে বোঝা চাপিয়ে দিয়ে এখন অবসর নিয়ে চলেও গেছেন। বিশেষ করে ১৩টি মিটারগেজ রেফ্রিজারেটর লাগেজ ভ্যানের একটিও ব্যবহার হচ্ছে না। গত বছরের অক্টোবরে বহরে যুক্ত হওয়ার পর থেকে এক বছর ধরে এগুলো পড়ে আছে। এসি লাগেজ ভ্যান কেনার প্রয়োজনই ছিল না। এ থেকে আয় না হলেও আগামী বছর প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর বৈদেশিক ঋণ কিন্তু পরিশোধ করতে হবে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, আম পরিবহনে ‘ম্যাংগো স্পেশাল ট্রেন’ চালায় রেলওয়ে। চার বছরে ১ কোটি ৮২ হাজার ৮৬০ টাকা লোকসান হয়েছে আম পরিবহনে। এরপরও লাভের কথা বলে লাগেজ ভ্যান কেনা হয়।

লাভ দেখিয়ে লাগেজ ভ্যান ক্রয়ের বিষয়ে বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. শামসুল হক আমাদের সময়কে বলেন, এগুলো চাপানো প্রজেক্ট। প্রকিউরমেন্টের সঙ্গে জড়িতরা বেনিফিট পান। এ জন্য যে সমীক্ষা করা হয়, সেগুলো ফরমায়েশি। ডেমু ট্রেন কেনার সময়ও একই অবস্থা হয়েছিল। লোকসান জেনেও লাভ দেখানো হয়। এ ধরনের ঘটনায় উন্নত দেশ হলে অনেকের চাকরি চলে যেত। ফাঁকা বুলি শুনিয়ে প্রকল্প নেওয়া এক ধরনের দুর্নীতি। অনুমোদন প্রক্রিয়ায় এগুলো ধরা উচিত ছিল। কেবল রেলই নয়, পরিকল্পনা কমিশনও এর দায় এড়াতে পারে না। গত সরকারের সময়ে জবাবদিহিতার ক্ষেত্র অনেকটাই কমে গিয়েছিল। আর তাই বিচারহীনতাও বেড়ে গিয়েছিল। এসব প্রকল্পের কারণে ঋণের জালে পড়ছে দেশ। এটি বড় দুর্নীতি। কিছু কর্মকর্তা বিদেশ ভ্রমণ, সম্মানী ইত্যাদি পান; কেউ কেউ সরাসরিও বেনিফিশিয়ারি হন এসব প্রকল্পের মাধ্যমে। কর্মকর্তার বাইরেও অনেক ‘সুবিধাভোগী’ থাকতে পারেন।

লাগেজ ভ্যানের বিষয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক সরদার সাহাদাত আলী জানান, দীর্ঘদিন লাগেজ ভ্যান ছিল না। তাই চাহিদা নেই। সেবা নিশ্চিত করতে ব্রান্ডিং করতে হবে। সবাইকে জানাতে হবে। তার চেয়ে বড় কথা ডোর টু ডোর সার্ভিস দিতে না পারলে লাভ হবে না। নতুবা লোকসান হতেই থাকবে।

জানা গেছে, লাগেজ ভ্যান কেনায় চীনের সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ২০২০ সালের ৩১ আগস্ট ৩৫৮ কোটি ৩৯ লাখ টাকার চুক্তি হয়। মিটারগেজ লাগেজ ভ্যানের প্রতিটির দাম ২ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। ব্রডগেজ লাগেজ ভ্যানের প্রতিটির দাম ৩ কোটি ৫ লাখ টাকা। ২০১৮ সালের ২৬ জুন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে একনেক বৈঠকে প্রকল্প অনুমোদিত হয়।

জানা গেছে, গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত তিন ধাপে রেলের বহরে যুক্ত ভ্যানগুলোর মাত্র ৪৭টি চলছে। ১২৫ ভ্যানের ২৫টি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত রেফ্রিজারেটর ভ্যান। মাছ, দুধ, ডিম পরিবহনে কেনা হয়েছিল। কৃষিপণ্য পরিবহনে সম্প্রতি রেলওয়ের তিনটি লাগেজ ভ্যান সার্ভিস চালু হয়েছে। খুলনা থেকে ঢাকা পর্যন্ত দুই লাখ টাকার ডিজেল পুড়িয়ে ছয় লাগেজ ভ্যানের ট্রেন ৬৪০ কেজি সবজি পরিবহন করে হাজার দেড়েক টাকা আয় করে। পঞ্চগড় ও চাপাইনবাবগঞ্জ থেকে চালানো লাগেজ ভ্যানে এক কেজিও কৃষিপণ্য আসেনি। এই হলো বর্তমান চিত্র। আর চালুর পরের আয়ের বিবরণ আরও ভয়াবহ। চলতি বছরের প্রথম আট মাসে নতুন লাগেজ ভ্যান থেকে আয় হয়েছে ৮ কোটি টাকা ২৯ লাখ টাকা। নতুনের চেয়ে ৪০ বছরের পুরনো ভ্যানের আয় কিঞ্চিত ভালো। ৫১ লাগেজ ভ্যান থেকে গত বছরের প্রথম আট মাসে রেলের আয় হয়েছিল ৯ কোটি ৯১ লাখ টাকা।

সূত্র জানিয়েছে, প্রতিটি ল্যাগেজ ভ্যানের সক্ষমতা ১০ টন। এ বছরের প্রথম আট মাসে ভ্যানে পণ্য পরিবহন করেছে মাত্র ৫৯ হাজার ৪০০ টন। অথচ ছয় লাখ টনের বেশি পণ্য পরিবহনের সক্ষমতা ভ্যানগুলোর। আগের বছরের একই সময়ে ৪০ বছরের পুরনো ভ্যানে পণ্য পরিবহন করা হয়েছিল ৭০ হাজার ৯০০ টন। নতুন ভ্যান যোগ হওয়ায় পণ্য পরিবহন উল্টো কমেছে। ৭৫ মিটারগেজ লাগেজ ভ্যানের ২৬টি চট্টগ্রাম পোর্ট ইয়ার্ডে রয়েছে। ইনশপে রয়েছে ১২টি। পূর্বাঞ্চলের পাঁচটি আন্তঃনগর ট্রেনে ছয়টি এবং চারটি মেইল ট্রেন ১৬টিসহ মোট ২২টি লাগেজ ভ্যান চলছে। আর পশ্চিমাঞ্চলে পাঠানো ৮টির ৪টি চলছে। এ হিসাবে ৭৫ ভ্যানের ২৬টি চলছে। ৫০ ব্রডগেজ লাগেজ ভ্যানের ১৪টি চলছে আন্তঃনগর ট্রেনের সঙ্গে। সাতটি চলছে সদ্য চালু করা কৃষি ট্রেনে। দুই অঞ্চল মিলে ৪৭টি ভ্যান চলছে। বাকিগুলো পড়ে আছে।

ব্যবসায়ীদের যুক্তি-কাঁচাপণ্য ক্ষেত থেকে সড়কপথে সরাসরি বাজারে যায় যে কোনো গাড়িতে। কিন্তু ট্রেনে নিতে প্রথমে প্রারম্ভিক স্টেশনে নিতে হয়। সেখানে আনলোডের পর ফের ট্রেনে লোড করতে হয়। প্ল্যাটফরম পর্যন্ত পণ্য নেওয়া যায় না গাড়িতে। ফলে ট্রেনে তুলতে আরেক দফা আনলোড করতে হয়। একই অবস্থা গন্তব্য স্টেশনে পণ্য খালাসে। এতে ব্যয় এবং সময় বেশি লাগে। আবার হিমায়িত পণ্য স্টেশনে বাড়তি সময় থাকলে নষ্ট হয়। এসব কারণে কাঁচামালের চাহিদা পায় না রেল।

এ বিষয়ে সড়ক পরিবহন ও রেলপথ উপদেষ্টা ড. ফাওজুল কবির খান গতকাল রাতে আমাদের সময়কে বলেন, অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প নেওয়ার বিস্তর অভিযোগ আমরাও পাচ্ছি। এক্ষেত্রে প্রকল্পের শুরুতেই শুরু হয় অনিয়ম। এসব বিষয় পর্যালোচনার জন্য আমরা উপদেষ্টাদের কয়েকজন শিগগিরই বৈঠকে বসব এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেব।

সূত্র: আমাদের সময় 

No comments:

Post a Comment

এনএসআইয়ে ‘র’ নেটওয়ার্ক। (BDC CRIME NEWS24)

BDC CRIME NEWS24 এনএসআইয়ে ‘র’ নেটওয়ার্ক: প্রকাশ : ১৯ আগস্ট ২০২৫, ০৮: ২৭ বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআইয়ের অভ্যন্তরে ২০০৯ ...